কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা এবং কথিত খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারত ও কানাডার মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। এ বছরের জুনে ঘটা নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত- এমন অভিযোগ তুলে দেশটির এক কূটনীতিককে সোমবার বহিষ্কার করে কানাডা। এ ঘটনার একদিন পরই পাল্টা জবাব হিসেবে কানাডার এক কূটনীতিককে নিজ দেশ থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে ভারত সরকার।
এ ঘটনায় গত কয়েক মাস ধরে দেশ দুটির মধ্যে চলমান কূটনৈতিক বিবাদ আরও জটিল হয়ে উঠল।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, কানাডার একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে তিনি ঠিক কোন কূটনীতিক, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানায়নি দেশটি।
শুধু তাই নয়, এ সিদ্ধান্ত যে সোমবার কানাডার ওই সিদ্ধান্তের পাল্টা জবাব, তা স্পষ্ট করা হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে। তাতে বলা হয়েছে, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কানাডিয়ান কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ এবং ভারত-বিরোধী কার্যকলাপে তাদের সম্পৃক্ততা উদ্বেগের। ক্রমবর্ধমান এই উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই কূটনীতিক বহিষ্কারের এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
ভারতীয় বংশোদ্ভূত খালিস্তানপন্থী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যায় ভারতের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা নিয়ে তদন্ত করা হবে বলে সোমবার জানান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। দেশটির পার্লামেন্টে দেয়া বিবৃতিতে ট্রুডো বলেন, ‘কানাডার মাটিতে কানাডার কোনো নাগরিককে হত্যায় কোনো বিদেশি সরকারের সম্পৃক্ততা আমাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে।’
চলতি বছরের জুনে কানাডায় অজ্ঞাত দুই দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন কানাডিয়ান শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার। দেশটির সারে শহরের গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারার পার্কিং লটে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
কানাডার গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারার সভাপতি ছিলেন নিজ্জার।
গত বছরই তাকে ‘ওয়ান্টেড টেরোরিস্ট’ ঘোষণা করে ভারত সরকার। নিজ্জারের হত্যায় ভারত জড়িত বলে সম্ভাব্য তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে কানাডার সংবাদমাধ্যম গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকা।
কানাডার ওই পত্রিকার অভিযোগ ভারত সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করলেও সোমবার কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলিনি জলি জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে কানাডা সরকার এক ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। বহিষ্কৃত ওই কূটনীতিক ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কানাডা উইংয়ের প্রধান বলে জানা গেছে।
এ ঘটনার পর ভারতের সঙ্গে কানাডার সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
আগামী অক্টোবরে বাণিজ্য চুক্তি করতে ভারতে আসার কথা ছিল কানাডা প্রতিনিধি দলের। কিন্তু গত ১৫ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয় দেশটি। কোনো কারণ উল্লেখ না করেই ‘বাণিজ্য মিশন’ নামের ওই চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেন কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী ম্যারি নাগের মুখপাত্র শান্তি কসেন্টিনো।
সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনেও শিখ নেতা হত্যা ইস্যুতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সমালোচনা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সম্মেলনকালে ট্রুডোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়ও বসেননি মোদি। এমনকি তার ফেরার সময়ও তাকে বিদায় জানাননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ফলে তখন থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন ওঠে।
ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই কানাডা সরকার বাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে গেছে বলে একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়।
২০১৭ সালের জুনে শিখস ফর জাস্টিস (এসএফজে) নামের একটি সংগঠন পাঞ্জাবের স্বাধীনতার দাবিতে ২০২০ সালে গণভোট আয়োজনের ডাক দিয়েছিল। সংগঠনটির পক্ষ থেকে কানাডা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই গণভোটের পক্ষে প্রচার চালানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি ভারত।
প্রসঙ্গত, ষোড়শ শতাব্দীতে দাস হয়ে আটলান্টিক উপকূলে বসতি গড়েছিলেন ভারতীয়রা। কালক্রমে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডায় সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা সম্প্রদায় হয়ে ওঠে ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়। দেশটির সবচেয়ে বড় বিদেশি সম্প্রদায় চায়নিজ-কানাডিয়ানদের পরে ১৩ লাখেরও বেশি শিখ। এই সম্প্রদায় এখন কানাডার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বেশ প্রভাবশালী।
ট্রুডোর মন্ত্রিসভাতেও রয়েছেন শিখ মন্ত্রী। ২০১৭ সালে ভারতের পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ তোলেন, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছেন কানাডার মন্ত্রীরা। এরপর থেকে বার বারই এমন অভিযোগ তুলে আসছে মোদি সরকার।