বিমান বিধ্বস্ত হয়ে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধাদের গ্রুপ ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের মৃত্যুর ঘটনা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে প্রশ্ন জেগেছে- এটি নিছকই একটি বিমান দুর্ঘটনা নাকি সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র রয়েছে?
ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনসহ সাত যাত্রী নিয়ে বুধবার মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের উদ্দেশে উড়াল দেয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে বিমানটিতে থাকা তিনজন ক্রুসহ ওই সাতজনই নিহত হন।
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রিগোজিন নিহত হওয়ার ঘটনাটিকে নিছক কোনো দুর্ঘটনা হিসেবে দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা এটিকে ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহের বদলা হিসেবে হত্যাকাণ্ড বলে মনে করছেন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধারা সামনের কাতারে থেকে যুদ্ধ করে এসেছে। বছর গড়িয়ে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এই গ্রুপের তৎপরতা ছিল ব্যাপক আলোচনার বিষয়।
ছন্দপতন ঘটে গত জুনের দিকে এসে। মস্কো চাহিদামতো অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে না- এমন অভিযোগ তোলেন ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন।
এর ধারাবাহিকতায় ২৩ জুন অস্ত্র সংকটের অভিযোগ তুলে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে নিজ সেনাদের সরিয়ে নেয়া ও পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন ওয়াগনার বস। তিনি বাহিনী নিয়ে মস্কো অভিমুখে সদলবলে অগ্রসর হন। ধারণা করা হচ্ছে, ওই বিদ্রোহ করাটাই ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের জন্য কাল হয়েছে।
বিদ্রোহের ওই ঘটনার পর দু’পক্ষে সমঝোতা এবং রাশিয়ার পক্ষ থেকে প্রিগোজিনসহ ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভলাদিমির পুতিন যে প্রিগোজিনকে সহজে ছেড়ে দেবেন না তেমন ধারণা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা একাধিক নেতা ও বিশ্লেষকের কণ্ঠে প্রকাশ পেয়েছে।
প্রিগোজিন নিহত হওয়ার ঘটনাটিকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আমি জানি না ঠিক কী হয়েছে। তবে এ ঘটনায় আমি বিস্মিত নই। কারণ রাশিয়ায় পুতিনের নির্দেশ ছাড়া তেমন কিছুই ঘটে না।’
ওয়াগনার-ঘনিষ্ঠ টেলিগ্রাম চ্যানেল গ্রে জোন জানায়, মস্কোর উত্তরে টিভার অঞ্চলে বিমানটিকে গুলি করে নামায় রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী। বিমানটি ভূপাতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ধরে যায়।
এটিকে দুর্ঘটনা হিসেবে মানতে নারাজ প্রিগোজিনের অনুসারীরা। প্রো-ওয়াগনার মেসেজিং অ্যাপ চ্যানেলে তাদের দাবি, বিমানটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে নামানো হয়েছে। এমনকি বিমানে রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র হামলাও চালিয়ে থাকতে পারে। আবার ‘বিমানে আগে থেকেই বোমা রাখা ছিল’- এমন দাবিও উড়িয়ে দিচ্ছে না তারা।
গত ২৪ জুন রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউনুস-বেক ইয়েভকুরভের সঙ্গে সাক্ষাত করেন প্রিগোজিন। ছবি: সংগৃহীত
প্রিগোজিন-অনুসারীদের এ দাবিগুলো যাচাই করা যায়নি বলে জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েট প্রেস। তবে একইসঙ্গে সংবাদমাধ্যমটি বলছে, এর আগে পুতিনের অসংখ্য বিরোধী ও সমালোচককে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ন্যাটোর কৌশলগত যোগাযোগ বিভাগ সেন্টার অফ এক্সিলেন্সের পরিচালক ইয়ানিস সার্টস লাটভিয়ান টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিমানটি ভূপাতিত হওয়া কোনোভাবেই কাকতালীয় ঘটনা নয়।’
এ সপ্তাহেই ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়ার শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিন বরখাস্ত হন। প্রিগোজিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর আসে। ওয়াগনারের বিদ্রোহের পর থেকে সুরোভিকিনকেও আর জনসম্মুখে আসতে দেখা যায়নি।
এদিকে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রিগোজিন নিহত হওয়ার ঘটনায় পুতিনের মধ্যে আপাতত কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়নি। তাকে যথেষ্টই শান্ত দেখা গেছে। প্রিগোজিন নিহত হওয়ার খবর প্রকাশের পরও তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে দেখা যায়।
ওয়াগনার প্রধান নিহত হওয়ার খবর বিভিন্নভাবে চারদিকে ছড়ালেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটিকে পুতিনের পক্ষ থেকে দেয়া শাস্তি হিসেবেই দেখছেন। কারণ হিসিবে তারা বলছেন, প্রিগোজিন বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ২৩ বছরের শাসনামলে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভিত্তি সবচেয়ে বেশি নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন।
২৩ জুন যা ঘটেছিল
যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র সংকটের কারণে ওয়াগনার যোদ্ধারা মারা যাচ্ছেন জানিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করতে রুশ বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান প্রিগোজিন। যুদ্ধের নীতি-কৌশল নিয়েও ওয়াগনার প্রধানের সঙ্গে রাশিয়ার শীর্ষ কমান্ডারদের মতবিরোধ দেখা দেয়।
সেনাদের মরদেহের মাঝে দাঁড়িয়ে সেদিন ওয়াগনার প্রধান বলেন, রাশিয়া চাহিদা অনুযায়ী অস্ত্র সরবরাহ করছে না। পরিস্থিতি না বদলালে তার সেনাদের যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রত্যাহার করে নেবেন।
এ নিয়ে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সামরিক প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের সঙ্গে তার প্রকাশ্য বিরোধ সামনে চলে আসে।
২০১১ সালে মস্কোয় প্রিগোজিনের রেস্তোঁরায় রাতের খাবার খাচ্ছেন পুতিন। পরিবেশন করছেন প্রিগোজিন। ছবি: সংগৃহীত
২৩ জুন প্রিগোজিন রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তার সেনাদের ওপর বিমান হামলার অভিযোগ করেন। এর প্রতিবাদে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাতের লক্ষ্যে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে মস্কো অভিমুখে অভিযান শুরু করেন তিনি। পথে রোস্তভ-অন-দনসহ কয়েকটি শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় ওয়াগনার যোদ্ধারা। ওয়াগনারের নিয়ন্ত্রণে যায় গুরুত্বপূর্ণ একটি রুশ সেনা ঘাঁটিও।
ওয়াগনারের অগ্রযাত্রা এবং পুতিনের পাল্টা হুঁশিয়ারি মুখোমুখি সংঘাত অনিবার্য করে তোলে।
পুতিন ওয়াগনার বাহিনীর এ বিদ্রোহকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এটি পিঠে ছুরি মারার মতো।’ এ ঘটনায় জড়িতদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ারও ঘোষণা দেন তিনি।
পরবর্তীতে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় ২৪ জুন অভিযান বন্ধের ঘোষণা দেন প্রিগোজিন।
বেলারুশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পুতিনের সম্মতিতে তাদের সঙ্গে প্রিগোজিনের আলোচনা হয়েছে। লুকাশেঙ্কো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দেন। বিনিময়ে ওয়াগনার যোদ্ধাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার বিষয়ে মতৈক্য হয়।
বিদ্রোহের পর ওয়াগনার সেনারা বেলারুশে চলে যান বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর হয়। তারপর থেকে আবারও প্রিগোজিন মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ, বেলারুশ ও আফ্রিকায় তার যোদ্ধাদের নিযুক্ত করে। মস্কোর সঙ্গে বিরোধ সত্ত্বেও ওয়াগনার বাহিনী রাশিয়ার পক্ষে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।
তবে সে সময় থেকেই প্রিগোজিনের অবস্থান নিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন জল্পনা। শোনা যায়, তিনি বেলারুশে আছেন। তার রাশিয়া সফর এবং পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার খবরও জানা যায়। তবে ওই ঘটনার পর থেকে কখনোই তাকে জনসম্মুখে আসতে দেখা যায়নি।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে প্রিগোজিনের একটি ভিডিও প্রকাশ পায়। তাতে তিনি জানান, আফ্রিকায় রাশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় তিনি তার যোদ্ধাদের একটি অংশ নিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন।
ওই ভিডিও প্রকাশ ও তার কয়েকদিন পরই ওয়াগনার প্রধানের মৃত্যুর খবরে দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার বিষয়টির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- রাশিয়ায় ওয়াগনার বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করতেই তাদের একটি অংশকে আফ্রিকায় পাঠানো হয়। বাহিনীটিকে নির্মূল করার সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনার অংশ এটি।
তবে প্রিগোজিনের মৃত্যু ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ গত ১৮ মাসে ইউক্রেনের অনেক অঞ্চল রুশ দখলে নিতে সহযোগিতা করলেও জুনের ওই বিদ্রোহের পর থেকে তারা ইউক্রেন যুদ্ধে কার্যত আর সক্রিয় নেই।