ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠকের দিকে নজর রাখছিল বিশ্ব। শক্তিধর দুই দেশের রাষ্ট্রনেতার মধ্যে কী কী নিয়ে কথা হবে তা ছিল বৈশ্বিক আলোচনায়।
জো বাইডেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর ও বাইরে থেকে চাপ ছিল, বৈঠকে তিনি যেন ভারতে ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সংশ্লিষ্টতায় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সংখ্যালঘুদের দমনে তৎপরতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, জাতিগত নিপীড়নসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন।
কারণ, অতীতে এবং সম্প্রতি ঘটা কয়েকটি সহিংসতায় সরাসরি মোদির অংশগ্রহণ রয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
কিন্তু বৃহস্পতিবার দুই নেতার বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানা গেল, বাইডেন মোদির সামনে এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্নই তোলেননি। নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের চেয়ে দুই নেতার আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে অন্যান্য দেশের ইস্যু। সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও কথা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনের ভাষ্য ছিল, অন্য দেশগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর সহযোগী হবে। ইস্যুগুলোতে দুই দেশের অবস্থান একই রাখার চেষ্টা করা হবে। আর এ সারাংশ বর্ণনায় বার বার ‘গণতন্ত্র রক্ষার’ দোহাই দেয়া হয়। সে সঙ্গে ইঙ্গিত দেয়া হয়, দুই দেশই গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সমমনা।
নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল হোয়াইট হাউসে রাষ্ট্রীয় ডিনার। সেখানে জো বাইডেন ভারতকে বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘দুটি মহান জাতি, মহান বন্ধু, বড় শক্তি, চিয়ার্স।’
বাইডেন আরও বলেন, ‘ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ডিএনএ-তে গণতন্ত্র রয়েছে। আমরা সেটা মেনে চলব।’
সংবাদ সম্মেলনে দুই নেতার ভাষ্য মতে, ইউক্রেনে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পাশে দাঁড়িয়ে মোদি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে ভারত এর সমাধানে জোর দিয়ে আসছে। অঞ্চলটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে ভারত প্রস্তুত।’
বৈঠকে দুই নেতা মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়া নিয়ে চিন্তিত বলে জানান। ভারতের জাতিগত মানবাধিকার বিষয়ে প্রশ্ন না উঠলেও বাইডেন ও মোদি মিয়ানমারে গণতন্ত্র হটানোর প্রেক্ষাপটে ঘটা চলমান সহিংসতা সমাধানে আলোচনা করেন। এতে তারা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন বলেও তাদের কথায় প্রকাশ পায়।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই নেতা মূলত মিয়ানমারে চীনের আধিপত্য নিয়ে চিন্তিত। চীনের প্রভাব বলয় থেকে দক্ষিণ এশিয়াকে মুক্ত করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দিকে এগুচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কোয়াডের মতো সামরিক জোট শক্তিশালী করার উদ্যোগে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
সে সঙ্গে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান প্রসঙ্গে দুই নেতা আলোচনা করেন। তারা একমত হন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসী ও ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর অভয়ারণ্য হতে দেয়া হবে না। ইস্যুটি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কর্মপরিকল্পনায় জোর পাবে।
এ আলোচনার সূত্র ধরেই আল-কায়েদা, আইসিস, লস্কর-এ-তাইয়েবাসহ জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত জঙ্গি সংগঠনের কথা উঠে আসে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একমত হয়, বিশ্বজুড়ে শান্তি ও গণতন্ত্র রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠায় জঙ্গিগোষ্ঠী নির্মূলে দুই দেশ কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে শান্তি-শৃঙ্খলার প্রশ্নে একে অপরের সমর্থন পাবে।
সামরিক জোট কোয়াড নিয়েও দুই নেতা আলোচনা করেন। এতে কোয়াড শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার বিষয় উঠে আসে। দুই পক্ষ কোয়াডকে আরও কার্যকরী করে গড়ে তোলার ব্যাপারে সম্মত হয়।
এ ছাড়া বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রে মোদির সফরে দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা, সেমিকন্ডাক্টর এবং খনিজ সম্পদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে একাধিক চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়। তবে চুক্তিগুলোর বিস্তারিত তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয়নি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কয়েকটি সূত্র বলছে, পরমাণু বিদ্যা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সামরিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন মোদি। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আন্তঃদেশীয় সিদ্ধান্তে ভারতের প্রকাশ্য বিরোধিতা না করার নিশ্চয়তা পেয়েছেন জো বাইডেন।