স্কটল্যান্ডের বালমোরাল দুর্গে মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসনে থাকা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের। তার প্রস্থানের মধ্য দিয়ে অবসান হয়েছে ৭০ বছরের বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ের।
রানির বিদায়ে শোকাহত যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। দেশে দেশে চলছে তার কর্ম ও জীবন নিয়ে আলোচনা। সংবাদমাধ্যমগুলো প্রকাশ করেছে নানা খবর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর টালমাটাল দুনিয়ায় জন্ম নেয়া শিশুটি কীভাবে একুশ শতকের শুরুর প্রান্তিক পর্যন্ত বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে চলেছেন, তার বয়ান তুলে ধরেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরূপ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে রাজতন্ত্র যখন সেকেলে পদ্ধতি হওয়ার ঝুঁকিতে, তখনও রাজমুকুটের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হয়েছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে।
সমুন্নত, নির্ভরযোগ্য এ ব্যক্তি তার দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলায় সহায়তা করেছেন। তিনি রীতিনীতি বদলে আদালতকে আরও উন্মুক্ত ও প্রবেশযোগ্য করেছিলেন। এসব তিনি করেছেন ক্রমশ বিরূপ ও বিরোধী হতে থাকা সংবাদমাধ্যমের নজরে থেকেই।
তার অধীনে থাকা দেশ কখনও কখনও পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে চলতে হিমশিম খেয়েছে। জনগণের প্রত্যাশার মুখে তার পরিবারকে প্রায়ই বেকায়দায় পড়তে হয়েছে, কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও নিজেকে স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে ধরে রাখতে পেরেছিলেন রানি। একই সঙ্গে তিনি উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ সরিয়ে প্রজাতন্ত্রীদের কাছ থেকে পর্যন্ত ক্ষীণ সমীহ আদায় করতে পেরেছিলেন।
বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ব্রিটেনের মূর্তমান প্রতীক, কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন রহস্যেঘেরা। কখনোই কাউকে সাক্ষাৎকার দেননি রানি। কোনো বিষয়ে প্রকাশ্যে তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ কিংবা ব্যক্তিগত মত দেয়ার ঘটনা বিরল। তিনি ছিলেন এমন এক নারী, যাকে অগণিত জনতা চিনলেও তার সম্বন্ধে জানা মানুষের সংখ্যা বিরল।
টেলিভিশনে ২০১২ সালে প্রচারিত এক ডকুমেন্টারিতে রানির নাতি প্রিন্স উইলিয়ামকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি মনে করি, তিনি তার দায়িত্বে প্রাণ, শক্তি ও আবেগের সঞ্চার করেছেন। তার মতো কেউই রাজতন্ত্রের আধুনিকায়ন ও বিবর্তন ঘটাতে পারেননি।’
রাজত্বকালের আদ্যোপান্ত
লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে ১৭ ব্রুটন স্ট্রিটে ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল জন্ম হয় এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরির। শৈশবে সিংহাসনে আরোহণের প্রত্যাশা একেবারেই করেননি প্রিন্সেস এলিজাবেথ। সে ভাবনায় পরিবর্তন আসে ১৯৩৬ সালে।
বিয়েবিচ্ছেদ করা আমেরিকান নারী ওয়ালিস সিম্পসনের প্রেমে পড়ে ওই বছর সিংহাসন ছেড়ে দেন এলিজাবেথের চাচা অষ্টম এডওয়ার্ড। রাজমুকুট ওঠে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জের মাথায়। ভবিষ্যৎ রানির বয়স তখন ১০ বছর।
২৫ বছর বয়সে স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে কেনিয়া সফরের সময় বাবার মৃত্যুর খবর পান প্রিন্সেস এলিজাবেথ। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ হিসেবে বাবার উত্তরসূরি হন তিনি। তার রাজত্বকালে বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন ১৫ জন প্রধানমন্ত্রী, যাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন উইনস্টন চার্চিল।
১৯৯২ সালে এক ডকুমেন্টারিতে রানিকে বলতে শোনা যায়, ‘এক অর্থে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। খুব অল্প বয়সে আমার বাবার মৃত্যু হয় এবং এটা ছিল আকস্মিক দায়িত্ব গ্রহণ…।’
রানির ৭০ বছর মেয়াদে নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কৃচ্ছ্রতাসাধনের পঞ্চাশের দশক দেখেছেন। দোদুল্যমান ষাটের দশক, লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচারের নেতৃত্বাধীন আশির দশক, টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির তিন মেয়াদের শাসন, ফের অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রতায় ফেরা এবং করোনাভাইরাস মহামারিজনিত পরিস্থিতিতে দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
সিংহাসনে তার ৭ দশক সময়কালে লেবার ও কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার এসেছে, বিদায় নিয়েছে। নারীবাদের কারণে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। যুক্তরাজ্য অনেক বেশি বৈশ্বিক, বহু জাতিগোষ্ঠীর মানুষের দেশ হয়েছে।
দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের পরের বছর ১৯৫৩ সালে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের মৃত্যু হয়। স্নায়ুযুদ্ধের বেশিরভাগটা দেখেছেন রানি।
তার রাজত্বকালে হ্যারি এস. ট্র্যুম্যান থেকে শুরু করে জো বাইডেন পর্যন্ত ১৪ জন প্রেসিডেন্ট দেখেছে যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের মধ্যে লিন্ডন জনসন বাদে সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে রানির।