মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে উপসাগরীয় অঞ্চলে কূটনীতিতে বিপাকে আছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
আলোচিত ওই নেতার নাম নূপুর শর্মা। এক টেলিভিশন বিতর্কে গত সপ্তাহে ইসলামের নবীকে নিয়ে নূপুর শর্মা এমন এক মন্তব্য করেন যা ভারতের মুসলিমদের পাশপাশি গোটা মুসলিম বিশ্বকে চরম ক্ষুব্ধ করেছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে গত রোববার দল থেকে বহিষ্কার করা হয় নূপুর শর্মাকে। একই অপরাধে বরখাস্ত করা হয়েছে বিজেপির দিল্লির মিডিয়া ইউনিটের প্রধান নবীন কুমার জিন্দালকে। টুইটে তিনি নূপুরের আপত্তিকর মন্তব্যের একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করছিলেন। যদিও পরে তা মুছে ফেলা হয়।
এক বিবৃতিতে বিজেপি জানায়, ‘কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মকে হেয় করে বা অপমান করে এমন আদর্শের বিরুদ্ধে তাদের দল। এ ধরনের দর্শনে যারা বিশ্বাসী তাদের বিজেপি সমর্থন করে না।’
ক্ষুব্ধ ইসলামিক দেশগুলোকে শান্ত করতে ভারতীয় কূটনীতিকরা বলছেন, ‘মন্তব্যগুলো সরকারের অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না। এগুলো তাদের নিজস্ব মতামত কেবল।’
তবে অনেক সূত্র বলছে, নূপুর শর্মা দলের বাইরের কেউ নন। রীতিমতো দলের গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ ৩৭ বছরের এই আইনজীবী।
কে এই নূপুর শর্মা?
দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত নূপুর ছিলেন বিজেপির সরকারি মুখপাত্র। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের পক্ষে সাফাই গাইতে প্রায়ই তাকে দেখা যেত টেলিভিশন বিতর্কে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময় নূপুর তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। সময়টা ২০০৮ সাল। হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ আন্দোলনের ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে প্রবেশ করেন রাজনীতিতে।
লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইনে স্নাতকোত্তর করার পর ২০১১ সালে ভারতে ফিরে আসেন নূপুর। সেই থেকে তার রাজনৈতিক জীবনে দ্রুত উত্থানের শুরু।
স্পষ্টভাষী ও সুবক্তা নূপুর ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষায় দারুণ সাবলীল। দৃঢ়তার সঙ্গে তার মতামতের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বিজেপির কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির মিডিয়া কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যান ২০১৩ সালে।
দুই বছর পর নতুন নির্বাচনে আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিপক্ষে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন এই নূপুর।
ভোটে কেজরিওয়ালকে হারাতে না পারলেও প্রচারে নূপুরের উদ্দীপনামূলক ভাষণ তাকে দলে আরও সামনের সারিতে নিয়ে আসে। দিল্লিতে দলের সরকারি মুখপাত্র নিযুক্ত হন, ২০২০ সালে নূপুর বনে যান বিজেপির ‘জাতীয় মুখপাত্র’।
নূপুর শর্মা ২০১৫ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ছবি: সংগৃহীত
টেলিভিশনে পরিচিত মুখ
গত কয়েক বছরে ভারতের টিভি দর্শকদের কাছে অতি পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন নূপুর শর্মা। প্রায়ই সন্ধ্যায় টেলিভিশনে তাকে দেখা যেত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। বিরোধীদের কোণঠাসা করতে গালিগালাজ করতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না নূপুর।
নূপুরের সমর্থকরা সম্প্রতি টুইটারে একটি ছোট ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করেন। এতে দেখা যায়, এক আলোচককে তিনি বলছেন, “আপনি একজন ‘ব্লাডি হিপোক্রিট অ্যান্ড আ লায়ার’ (ভণ্ড ও মিথ্যাবাদী)। এরপর তিনি তাকে বলেন 'শাট আপ'।" ভিডিওটি শেয়ার হয় ব্যাপক।
নূপুর যখন টুইটারে ওই ক্লিপটি শেয়ার করেন টুইটার হ্যান্ডেলে তখন তার পাঁচ লাখের বেশি ফলোয়ার ছিল; যার মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও।
এ ঘটনায় বিজেপির মধ্যে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে নূপুরের। সমর্থকরা তাকে ‘নারী সিংহ’, ‘নির্ভীক’ ও ‘একজন কঠিন লড়াকু’ বলে আখ্যা দেয়।
বরখাস্ত হওয়ার পর এক বিবৃতিতে নূপুর বলেন, ‘নিঃশর্তভাবে’ মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। তবে ওই মন্তব্যের পেছনে যুক্তি ছিল। ওই অনুষ্ঠানে দেবতা শিবকে অনবরত যেভাবে অপমান আর অসম্মান করা হচ্ছিল, তার জবাব দিতে ওই মন্তব্য করেছিলাম।’
— Nupur Sharma (@NupurSharmaBJP) June 5, 2022জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে বিতর্ক
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দাবি করছে, পবিত্র বারাণসি শহরে এই মসজিদ বানানো হয় ষোড়শ শতাব্দীর এক হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর। তাদের দাবি, মন্দিরটি ১৬৬৯ সালে ধ্বংস করেছিলেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব।
মসজিদের ভেতরে ভিডিওর মাধ্যমে একটি জরিপ চালানোর জন্য আদালতের একটি রায় নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। ওই ভিডিওতে পাথরের একটি স্তম্ভ দেখা যায়।
আবেদনকারীরা দাবি করেন, এটি শিবলিঙ্গ (শিবের প্রতীক)। তবে মসজিদ কর্তৃপক্ষ জোর গলায় বলেছিল, এটি একটি পানির ফোয়ারা।
এই বিতর্ক নিয়ে শুনানি চলছে আদালতে। বিষয়টি নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে চলছে বিরামহীন বিতর্ক। এসব অনুষ্ঠানে হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতামতের প্রধান ও সোচ্চার প্রবক্তা হয়ে ওঠেন নূপুর শর্মা।
এর মধ্যে ২৭ মে এক অনুষ্ঠানে তিনি মহানবীকে কটাক্ষ করে যেসব আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন, তা হজম কেবল নূপুরের জন্যই না, দল হিসেবে বিজেপির জন্যও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘শিরশ্ছেদের হুমকি’
সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়ের যখন নূপুরের ওই অবমাননাকর মন্তব্য টুইটারে শেয়ার করেন, তখন নূপুর পুলিশকে একটি টুইট করেন। সেখানে বলা হয়, 'ধর্ষণ হুমকির বার্তা পাচ্ছি। শুধু তা-ই নয়, আমার বোন, মা এবং বাবাকে হত্যা ও শিরশ্ছেদের হুমকিও দেয়া হচ্ছে।'
জুবায়েরের বিরুদ্ধে নূপুর অভিযোগ তোলেন, ‘মিথ্যা রটনা চালিয়ে পরিবেশ বিষাক্ত করছেন জুবায়ের, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করছেন। আমাকে ও আমার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন।’
টুইটটি তিনি ট্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির প্রেসিডেন্ট জেপি নাড্ডাকে।
তিন দিন পর এক সাক্ষাৎকারে নূপুর বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয় এবং পার্টি প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের সবাই আমার পাশে আছে’।
তবে পাশা পাল্টে যায় ২ মে, শুক্রবার। এদিন উত্তর প্রদেশের কানপুরে নূপুরের মন্তব্যের বিরুদ্ধে মুসলমানদের একটি প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়ে ওঠে সহিংস।
নুপুর শর্মার গ্রেপ্তারের দাবিতে চলা বিক্ষোভ। ছবি: সংগৃহীত
কট্টরপন্থী যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যতে এমন বিক্ষোভ মেনে নেয়া যায় না। তাই তিনি নিলেন শক্ত পদক্ষেপ। বিক্ষোভকারীদের কঠোর হাতে দমন করে পুলিশ। শত শত বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ, গ্রেপ্তার হন অনেকে।
এরপর বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নূপুরের বিবৃতির নিন্দা জানাতে শুরু করে। ফলে পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
কুয়েত, ইরান ও কাতার তাদের দেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব করে। কড়া বিবৃতি দেয় সৌদি আরব।
এমনকি যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে গত কয়েক বছরে ভারতের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উষ্ণ হয়েছিল, সেই দেশও এই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে।
এখানেই থেমে নেই বিক্ষুব্ধরা। ধর্ম অবমাননার দায়ে নূপুরের গ্রেপ্তারের দাবি দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে। বিরোধী দলশাসিত কয়েকটি রাজ্যের পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে মঙ্গলবার নূপুরের নিরাপত্তা জোরদার করেছে দিল্লি পুলিশ।
থেমে নেই নূপুরের সমর্থকরা। বহিষ্কারের পর অনলাইনে তার সমর্থন বাড়তে শুরু করেছে। #ISupportNupurSharma এবং #TakeBackNupurSharma এই হ্যাশট্যাগে প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নূপুরের প্রশংসা করছে তার সমর্থকরা।
কিছু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের মতে, এমন কাণ্ড অতীতেও ঘটেছে। অনেক শীর্ষ ভারতীয় রাজনীতিক এমন ঘৃণামূলক মন্তব্য করেও পার পেয়ে গেছেন। আর তাই নূপুর শর্মার রাজনৈতিক জীবনের ইতি এখানেই দেখছেন না তারা।