ভারতে যৌতুক প্রথা খুব সাধারণ বিষয়। মেয়ের বিয়েতে প্রায়শই মোটা অঙ্কের অর্থ যৌতুক দিয়ে থাকেন ভারতীয় বাবা-মায়েরা। সেই যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন সইতে না পেরে সন্তানসহ তিন বোনের একসঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনা নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ভারতের সমাজ ব্যবস্থাকে।
রাজস্থানের জয়পুরের কাছের একটি গ্রামের তিন বোন কালু, কমলেশ ও মমতা মীনার বিয়ে হয়েছিল একই বাড়ির তিন ভাইয়ের সঙ্গে। কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে একসঙ্গে ‘আত্মহত্যা’ করেন তারা। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সইতে না পেরে এ সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছিলেন বলে হোয়াটঅ্যাপে একটি বার্তা রেখে যান তিন বোন।
“আমাদের মৃত্যুর জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকজনই দায়ী। আমরা একসঙ্গে মরছি, কারণ এটা প্রতিদিন মারা যাওয়ার চেয়ে ভালো।”
তিনজনকেই মে মাসে তাদের শ্বশুরবাড়ির কাছে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সঙ্গে কালুর চার বছরের ছেলে এবং সদ্য জন্মানো আরেক সন্তান। আর কমলেশ ও মমতা দুজনেই ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা।
বিয়ের পর তিন বোন একই ছাদের নিচে বাস করতেন। তাদের স্বজনরা জানান, স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের নিয়মিত নির্যাতন করত।
“ওদের বাবা আরও অর্থের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায়, তারা প্রতিদিন নির্যাতিত হয়েছে।”
জয়পুর পুলিশ বলছে, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমরা একে আত্মহত্যা বলে বিবেচনা করছি।
হতভাগ্য তিন বোনের বাবা সরদার মীনা। তিনি বলেন, ‘ স্বামীর সংসার মেয়েদের জন্য একটি জীবন্ত নরক ছিল। ওদের পড়াশুনা করতে নিষেধ করা হয়েছিল। আরও অর্থের জন্য তাদের হয়রানি করা হতো।
‘আমরা তাদের (মেয়ের স্বামীদের) অনেক কিছু দিয়েছি। আপনি তাদের বাড়িতে দেখতে পারেন। বিছানা, টেলিভিশন এবং ফ্রিজ সবই দিয়েছিলাম।
‘আমি ৬ মেয়ের বাবা। আমারও-তো সীমাবদ্ধতা আছে। একজন কৃষকের আর কত আয় থাকতে পাড়ে। আমি তাদের শিক্ষিত করেছিলাম, তবে এটা ছিল বেশ কঠিন।’
এ ঘটনায় তিন জনের স্বামী, তাদের মা এবং বোনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলো।
‘পরিবারের মর্যাদা’
ভারত ৬০ বছরেরও বেশি আগে যৌতুক প্রথাকে নিষিদ্ধ করা হয়। দেশটির আইনে একে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
তবে আইন করেও থামানো যাচ্ছে না যৌতুক প্রথা। ভারতের বেশিরভাগ জায়গায় নারীদের বোঝা মনে করা হয় এখনও। তাই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ক্ষতিপূরণ (যৌতুক) দাবি করে ছেলে পক্ষ।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোয় নিয়মিত দাম্পত্য সম্পত্তির বিরোধের খবর প্রকাশ হয়, যেগুলোর শেষ হয় প্রাণনাশের মধ্য দিয়ে।
কেরালার দক্ষিণাঞ্চলে গত বছর এক স্বামী যৌতুকের দাবি এবং সম্পত্তির একক নিয়ন্ত্রণ পেতে স্ত্রীকে বিষাক্ত সাপ দিয়ে হত্যা করিয়েছিল। পরে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। সম্পত্তির মধ্যে ছিল ৫ লাখ রুপির একটি গাড়ি, যা যৌতুক হিসেবে দেয়া হয়েছিল।
ভারতের আইনে যৌতুকের জন্য চাপ দেয়াকেও অপরাধ হিসেবে ধরা হয়। কেরালার এক ব্যক্তিকে গত মাসে যৌতুক চাওয়ার অপরাধে ১০ বছরের জেল দেয় আদালত। রায়ে বিচারক জানান, এ ধরনের আচরণে ওই ব্যক্তির স্ত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হতো।
ভারতে বিয়েবিচ্ছেদের হার একেবারেই কম। সামাজিক নানা কারণে এ পদক্ষেপ নিয়ে আগ্রহী না নারীরা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০ দম্পতির মধ্যে কেবল একজনের ক্ষেত্রে বিয়েবিচ্ছেদ হয়।
মীনা বোনদের এই পরিণতির পরও তাদের স্বজনরা কোনো বিকল্প দেখছেন না! তাদের বাবা সর্দার বলেন, ‘বিয়ের পর পারিবারিক মর্যাদার খাতিরে তাদের শ্বশুর বাড়িতেই থাকা উচিত। অন্য বাড়িতে বিয়ে দিলে, সেখানেও যে এমন ঘটবে না তার নিশ্চয়তা দেবে কে?’
পরিশেষে
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসাবে, ২০২০ সালে অন্তত ৭ হাজার যৌতুক সংক্রান্ত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ভারতে; দিনে গড়ে প্রায় ১৯ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছিলেন। এ ছাড়া যৌতুক সংক্রান্ত ইস্যুতে ওই বছর এক হাজার ৭০০ জনের বেশি নারী আত্মহত্যা করেছেন।
এসব তথ্য অবশ্য পুলিশের কাছ থেকে নেয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতার অন্যান্য তথ্যের মতো মামলার প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।
ভারতের পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের কর্মী কবিতা শ্রীবাস্তব বলেন, ‘ঘণ্টায় কমপক্ষে ৩০-৪০ জন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। এগুলো কেবল নথিভুক্ত (মামলা)। প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হবে।
‘মীনা বোনদের সঙ্গে জড়িত যৌতুক বিরোধ তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। তারা স্বাধীনতা হারিয়েছিল। এগুলো নির্যাতনকারীদের প্রচেষ্টার একটি অংশ কেবল।’
এসবের আসল কারণ সামাজিক ট্যাবু বলে মনে করেন কবিতা শ্রীবাস্তব। তার ভাষ্য, ভারতে পারিবারিক সহিংসতা অনেকটায় স্বাভাবিক।
‘একজন নারী তখনই আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপ নেয়, যখন সে অনুভব করতে থাকে তার বৈবাহিক জীবনে আর কোনো আশা নেই। আমি মনে করি, রাষ্ট্র হিসেবে ভারত এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ।’