ইউক্রেনে চলছে রাশিয়ার সামরিক অভিযান। এখন পর্যন্ত রাজধানী কিয়েভ দখল করতে পারেনি রুশ সেনারা। পশ্চিমা অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে শক্ত প্রতিরোধ গড়েছে ইউক্রেনীয় সেনারা। এদিকে রাশিয়া অভিযোগ করেছে, রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র তৈরিতে ইউক্রেনকে সহায়তা করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ইউক্রেন এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তারা বলছে, রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্যই রাশিয়া নাটক সাজাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এই ধরনের হামলার পর জীবন বাঁচাতে ব্যবহার হয় এমন সরঞ্জাম সরবরাহ করার বিষয় নিয়ে চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
শুক্রবার ইউক্রেনে পাঠানো সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে সাহায্য প্রচেষ্টার কথা বলেছেন সাকি।
রাশিয়া যদি ইউক্রেনে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তবে দেশটিকে ‘কঠিন মূল্য’ দিতে হবে।
হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বিবৃতিটি এমন সময় এলো যখন কয়েক সপ্তাহ আগে জেন সাকি বলেছিলেন, রাশিয়া জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারে।
রাশিয়া যা বলেছিল
রুশ কর্তৃপক্ষের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইউক্রেন জাতিভিত্তিক জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছে। ইউক্রেনের জীবাণু গবেষণাগারগুলো এমন উপাদান তৈরির চেষ্টা করছে, যা একমাত্র বিশেষ জাতির মানুষদেরই আক্রান্ত করবে।
রুশ সশস্ত্র বাহিনীর তেজস্ক্রিয়তা, রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র প্রতিরোধ ট্রুপসের প্রধান ইগর কিরিলভ রুশ বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্সকে বলেছিলেন, ‘এটি খুব সম্ভব যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অন্যতম উদ্দেশ্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে বেছে বেছে আঘাত করতে সক্ষম জৈব-উপাদান তৈরি করা।’
কিরিলভ আরও বলেছিলেন, আমেরিকানরা এরই মধ্যে খারকিভ, কিয়েভ ও ওডেসার গবেষণাগারগুলো থেকে ডাটাবেস, জৈব উপাদান ও সরঞ্জাম, বিশেষ করে লেভিভের মহামারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর নথি সরিয়ে নিয়েছে। এর কিছু অংশ পোল্যান্ডে সরিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
২০১৮ সালে দামাস্কাসে রাসায়নিক বোমা হামলার শিকার শিশু। ছবি: সংগৃহীত
রাশিয়ার দাবির বিষয়ে যা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন
রাশিয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান অ্যাভরিল হেইন্স। এ ছাড়া সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটিকে দেয়া বক্তব্যে হেইন্স বলেন, ‘আমরা মনে করি না ইউক্রেন কোনো জৈব, রাসায়নিক অস্ত্র বা পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করছে।’
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনে কোনো রাসায়নিক বা জৈব গবেষণাগার পরিচালনা করে না যুক্তরাষ্ট্র। এই ধরনের কোনো অস্ত্রও তারা কোথাও তৈরি করছে না।’
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকিও রাশিয়ার অভিযোগকে মিথ্যা ও প্রপাগান্ডা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ইউক্রেন বলছে, এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কির মতে, রাশিয়া এমন অভিযোগ এনে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রেক্ষাপট তৈরি করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তবে দেশটিকে ‘কঠিন মূল্য’ দিতে হবে।
রুশ অভিযোগ নিয়ে যা বলেছে বিশেষজ্ঞরা
অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি ইউনিভার্সিটির জৈববিজ্ঞান ও খাদ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান প্রফেসর অলিভার জোন্স রাশিয়ার বিশেষ জাতিগোষ্ঠীকে লক্ষ্য বানিয়ে জৈব অস্ত্র তৈরির চেষ্টার দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার মতে, এগুলো বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে সম্ভব। বাস্তবে নয়।
প্রফেসর জোন্স বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আধুনিক ডিএনএ শনাক্তকরণ পদ্ধতি আপনার পূর্ব পুরুষ সম্পর্কে খুব বেশি হলে বলতে পারে সে কি ইউরোপীয় কিংবা আফ্রিকার, কোনো দেশ ধরে বলা সম্ভব নয়। আমরা বলতে পারি না একজন ব্যক্তি কোন দেশ থেকে এসেছেন। তাই এমন কোনো জীবাণু অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব নয়, যা কেবল বিশেষ সম্প্রদায় থেকে আসা ব্যক্তিদের অন্যদের করবে না। এমনটি হবে না।’
জোন্স বলেছেন, এটা পুরোপুরি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। মানুষের জিনগত সামঞ্জস্য অত্যন্ত বেশি, এটি সম্ভব নয়।
যা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
ইউক্রেনে জীবাণু ও ভাইরাস নিয়ে কাজ করে এমন অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইউক্রেন বলে আসছে, এগুলো শুধু রোগ প্রতিরোধ বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য, কোনো ধরনের জীবাণু অস্ত্র বানানোর জন্য নয়। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, ‘সম্ভাব্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে’ গবেষণাগারে রাখা বিপজ্জনক জীবাণু ধ্বংস করে ফেলার জন্য।
ইউক্রেনে কোনো রাসায়নিক বা জৈব গবেষণাগার পরিচালনা করে না যুক্তরাষ্ট্র। এই ধরনের কোনো অস্ত্রও তারা কোথাও তৈরি করছে না।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর পর থেকেই পশ্চিমাদের বাধা উপেক্ষা করে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে চলছে রুশ সেনাদের সামরিক অভিযান।
ইউক্রেনকে ‘অসামরিকায়ন’ ও ‘নাৎসিমুক্তকরণ’ এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের রুশ ভাষাভাষী বাসিন্দাদের রক্ষা করার জন্যই এমন সামরিক পদক্ষেপ বলে দাবি করে আসছে রাশিয়া। ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে রাশিয়া হামলা চালিয়েছে। দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে আসছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে শান্তি আলোচনার অংশ হিসেবে ইস্তাম্বুলে বৈঠকেও সুনির্দিষ্ট অস্ত্রবিরতির কোনো রূপরেখা আসেনি। এদিকে পশ্চিমা বিশ্ব একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করছে রাশিয়ার ওপর। গ্যাসের ওপর নির্ভর করে পাল্টা জবাব দিচ্ছে রাশিয়াও।