রাশিয়ার সেনারা চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকা ছাড়তে শুরু করেছে, এমনটাই জানিয়েছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান শুরুর পর উত্তর দিকে কিয়েভে অগ্রসর হওয়ার সময় রুশ সেনারা চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এর আশপাশের এলাকা দখলে নেয়।
আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএইএ জানিয়েছে, শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকাই নয়। রাশিয়ার সেনারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিকটবর্তী শহর স্লাভুটিচও ছেড়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, কিছু রুশ সেনা চেরনোবিলে অবস্থান করছিল, তবে তারাও এলাকা ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিল।
ইউক্রেন জানিয়েছে, ২৪ তারিখ থেকে চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্র দখলের পর এই প্রথম এর নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনীয় কর্মীদের কাছে ছেড়ে দিয়ে বেলারুশে চলে গেছে রুশ সেনাদের দুটি কনভয়।
আইএইএর পরিচালক রাফায়েল মারিয়নো গ্রসি বলেছেন, ‘চেরনোবিলে সহায়তা মিশন পাঠানোর বিষয়ে এরই মধ্যে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা।’
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালনা দল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি নথি প্রকাশ করে জানিয়েছে, তেজস্ক্রিয় দূষণ রোধে বসানো বিশাল ধাতব হ্যাঙ্গারসহ পুরো বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্ব ইউক্রেনীয় কর্মীদের কাছে ছেড়ে দিয়েছে রাশিয়া।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত নথিতে প্ল্যান্টটি রক্ষার দায়িত্বে থাকা রাশিয়ান ন্যাশনাল গার্ড ইউনিটের কমান্ডার, রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তি সংস্থা রোসাটমের প্রতিনিধি এবং ঘূর্ণায়মান প্ল্যান্টে কাজ করা দুই শিফটের প্রধানের স্বাক্ষর রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের বিদ্যুৎকেন্দ্রেই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক দুর্ঘটনা হয়। তেজস্ক্রিয় দূষণরোধে সে সময় বিস্ফোরিত রিঅ্যাক্টরকে ধাতব পদার্থ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়।
এর আগে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, রাশিয়ার গোলা নিক্ষেপের কারণে চেরনোবিলের নিষিদ্ধ এলাকার বনাঞ্চলে আগুন লাগছে। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় পারমাণবিক বিপর্যয়। চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে থাকা বনাঞ্চলের আয়তন ২৫ একর।
ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, রুশ গোলার আঘাতে সৃষ্ট আগুন পুরো বনাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রেও আগুন পৌঁছে যেতে পারে। এমন অবস্থায় ইউক্রেন পারমাণবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে, যা পুরো বিশ্বের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে আসতে পারে।
চেরনোবিল ছেড়ে বেলারুশে চলে গেছে রুশ সেনারা। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের রাজনীতিবিদ ইন্না সোভসান টুইটারে এক বার্তায় সে সময় বলেছিলেন, আসন্ন নরক ঠেকাতে তেমন কিছু করার নেই ইউক্রেনের, কারণ চেরনোবিল এলাকা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এরই মধ্যে চেরনোবিল জোনের ১০ হেক্টর বনাঞ্চল রাশিয়ার গোলা নিক্ষেপের ফলে সৃষ্ট আগুনে পুড়ে গেছে। আমরা ভয় পাচ্ছি, আগুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছে যেতে পারে। তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এরই মধ্যে উচ্চপর্যায়ে রয়েছে।
ইউক্রেনের হাতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া। যদিও রাশিয়ার স্টেট মিডিয়ার পক্ষ থেকে এর আগে জানানো হয়েছিল, চেরনোবিল নিষিদ্ধ এলাকায় কোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি।
শুধু চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েই নয়, ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর পারমাণবিক বিপর্যয়ের ব্যাপারে এর আগেও সতর্ক করা হয়েছে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে। এর আগেও রাশিয়ার গোলা নিক্ষেপে জাপোরিজ্জায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি ইউক্রেনের। সে সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।
ইউক্রেনের অভিযোগ ছিল, রুশ সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে পারমাণবিক চুল্লি লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার তুরস্কের শহর ইস্তাম্বুলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার শান্তি আলোচনার পর রুশ উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেকজান্ডার ফোমিন বলেছিলেন, মস্কো ইউক্রেনের আশপাশে ‘সামরিক তৎপরতা হ্রাস করবে।’ ধারণা করা হচ্ছে, চেরনোবিল ছেড়ে রুশ সেনাদের চলে যাওয়া, শান্তি আলোচনার পরে দেয়া রাশিয়ার প্রতিশ্রুতিরই অংশ।
চেরনোবিলে সহায়তা মিশন পাঠানোর বিষয়ে এরই মধ্যে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর পর থেকেই পশ্চিমাদের বাধা উপেক্ষা করে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে চলছে রুশ সেনাদের সামরিক অভিযান।
ইউক্রেনকে ‘অসামরিকায়ন’ ও ‘নাৎসিমুক্তকরণ’ এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের রুশ ভাষাভাষী বাসিন্দাদের রক্ষা করার জন্যই এমন সামরিক পদক্ষেপ বলে দাবি করে আসছে রাশিয়া। ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে রাশিয়া হামলা চালিয়েছে। দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে আসছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে শান্তি আলোচনার অংশ হিসেবে ইস্তাম্বুলে বৈঠকেও সুনির্দিষ্ট অস্ত্রবিরতির কোনো রূপরেখা আসেনি। এদিকে পশ্চিমা বিশ্ব একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করছে রাশিয়ার ওপর। গ্যাসের ওপর নির্ভর করে পাল্টা জবাব দিচ্ছে রাশিয়াও।