আশঙ্কা ছিল, তবে সত্যিই হামলা হবে হয়তো বিশ্বাস করেনি ইউক্রেনবাসী। সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে প্রতিবেশী ইউক্রেনে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভিযানে নামে রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন সামরিক অভিযান দেখেনি ইউরোপ। এর আগে পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহী অধ্যুষিত দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় ক্রেমলিন।
ইউক্রেন অভিযানের প্রথম সপ্তাহে কৌশলী রাশিয়াকে দেখা গেছে। স্থল, আকাশ ও সাগর থেকে ইউক্রেনের সামরিক ঘাঁটিগুলোয় হামলা চালায় পুতিন বাহিনী। এসব হামলায় ব্যবহার হয়েছে ক্রুজ মিসাইল।
পরের ধাপে স্থলপথে হামলা চালায় পুতিন বাহিনী। রকেট আর্টিলারি ও ক্লাস্টার বোমায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় শহরগুলো।
তৃতীয় ধাপে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর দখলে নেমেছে রুশ সেনারা।
স্ট্র্যাটেজিক স্ট্রাইক
অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টায় অনেকগুলো ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করে রাশিয়া। স্বল্পপাল্লার এই ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রথমবারের মতো কোনো যুদ্ধে ব্যাপক হারে ব্যবহার হয়।
আমেরিকার হিসাবে, প্রথম দিনে সাগর থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম এমন ১০০-র বেশি মিসাইল ছোড়ে মস্কো।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) গবেষণা বিশ্লেষক টিমোথি রাইট বলেন, ‘রাশিয়া সম্ভবত ইস্কান্দার-এম মিসাইল ব্যবহার করেছে।’
ইউক্রেনে পুরোনো ব্যালিস্টিক মিসাইলের সরবরাহ কম। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, যুদ্ধের প্রথম দিনে একটি ওটিআর-২১ তোচকা মিসাইল ব্যবহার করে কিয়েভ, যেটির লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার অভ্যন্তরে একটি বিমানঘাঁটি।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বলছে, ইস্কান্দার-এমের পাল্লা তোচকার চেয়ে বেশি; এটির লঞ্চার একাধিক মিসাইল বহন করতে পারে।
পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন সেনাবাহিনী দাবি করে, কৃষ্ণসাগর থেকে সুমি, পোলতাভা এবং মারিউপোল শহরের আশপাশে ৩এম১৪ ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইল হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। এসব মিসাইল ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
অন্যদিকে সোভিয়েত আমলের এস-৩০০ভি অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল সিস্টেম রয়েছে ইউক্রেনের। এগুলো অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইলও ছুড়তে পারে।
রাশিয়ার তৈরি ইস্কান্দার-এম মিসাইল। ছবি: সংগৃহীত
আইআইএসএসের গবেষণা বিশ্লেষক টিমোথি রাইট বলেন, ‘ইউক্রেন এই মিসাইল দিয়ে কোনো রুশ বিমান ধ্বংস করতে পেরেছে কি না তা জানা যায়নি। তবে ইউক্রেনের রাস্তায় এই মিসাইল সিস্টেম ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় দেখা গেছে।’
কিছু সমর বিশ্লেষক বলছেন, প্রথম দিনেই ইউক্রেন সরকারকে উৎখাত সম্ভব না হওয়ার কারণ হতে পারে মিশ্র মিসাইলের ব্যবহার। যদিও রাশিয়ার বিমান শক্তির কাছে ইউক্রেন কিছুই না। হতে পারে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো কাজ করেছে।
স্থল অভিযান
বিশাল রুশ সেনাবহর ইউক্রেনের পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে রাজধানী কিয়েভ এবং খারকিভ শহর ঘিরে ফেলে। এ সময় ইউক্রেনের সিভিল ডিফেন্স ইউনিট এবং স্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর শক্ত প্রতিরোধে পড়ে রুশ সেনারা।
শহুরে গেরিলা
শহুরে পরিবেশে লড়াই রুশ সেনাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ভবন এবং গাছ ইউক্রেনীয় সেনারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইউক্রেনীয়দের এমন প্রতিরোধেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে অভিযান।
আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনকে নানা অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে। এসব দিয়ে অনায়াসেই সাঁজোয়া যান ধ্বংস করা যায়। শহুরে পরিবেশে এসব অস্ত্র বেশ কার্যকর প্রমাণ হচ্ছে।
রুশ সেনা মোকাবিলায় ইউক্রেন ব্যবহার করছে ব্রিটেন ও সুইডেনের যৌথ উদ্যোগে তৈরি নেক্সট জেনারেশন লাইট অ্যান্টি ট্যাংক ওয়েপন (এনএলএডব্লিউ)। এ ছাড়া আছে আমেরিকার তৈরি এফজিএম ১৪৮ জ্যাভলিন মিসাইল, যা মুহূর্তেই কয়েক কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
আমেরিকার তৈরি এফজিএম ১৪৮ জ্যাভলিন মিসাইল। ছবি: সংগৃহীত
ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ছবিতে পরিত্যক্ত কিছু সাঁজোয়া যান পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এসব দেখে আমেরিকার কর্মকর্তারা রাশিয়ার লজিস্টিক সক্ষমতা নিতে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে এটি ক্রেমলিনের ব্যর্থতা নাকি কৌশল, তা নিয়ে সন্দিহান ওয়াশিংটন।
পুতিন বাহিনীকে মোকাবিলায় ইউক্রেনের অন্যতম হাতিয়ার বায়রাক্তার টিবি২ ড্রোন। তুরস্কের তৈরি এই ড্রোন ছোট অস্ত্র বহনে পারদর্শী। লেজার লাইটের সাহায্যে আট কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে বায়রাক্তার টিবি২।
তুরস্কের তৈরি ড্রোন বায়রাক্তার টিবি২। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, রাশিয়ান কনভয়ের যানবাহন ধ্বংস করতে এটি ব্যবহার হচ্ছে। রুশ অভিযানের আগে পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহী অধ্যুষিত অঞ্চলে এ ধরনের ড্রোন ব্যবহার করেছে কিয়েভ।
অবরোধের কৌশল
অবরোধ কৌশলে সাধারণত শত্রুর অবস্থান ঘেরাও, রসদ সরবরাহ এবং পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর অস্ত্র, স্থল সেনা এবং প্রকৌশলীদের সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে হামলা চালানো হয়ে থাকে।
অভিযানের তৃতীয় সপ্তাহে এ কৌশলে যায় রুশ বাহিনী। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হামলার আগে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া শুরু করে পুতিন বাহিনী। কিয়েভ ও খারকিভে এ কৌশলে দেখা গেছে তাদের।
ইউক্রেন অভিযানে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর আরেকটি মারণাস্ত্র বিএম-২১। মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেমটি (এমএলআরএস) একসঙ্গে ৭২০টি রকেট ছুড়তে পারে।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেনে থার্মোবারিক ওয়েপস সিস্টেম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। এর ব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা।’
থার্মোবারিক অস্ত্র জ্বালানি মিশ্রণের একটি মেঘ ছড়িয়ে দেয়। বায়ুতে থাকা অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে তা একটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটায়।
টিওএস-১ বুরাটিনো
ইউক্রেন অভিযানে টিওএস রকেট লঞ্চার ব্যবহার করছে রাশিয়া। রুশ সেনাদের ট্যাংকের চেসিসে দেখা গেছে মাল্টিপল এই রকেট লঞ্চারগুলো।
সোভিয়েত আমলের টিওএস রকেট লঞ্চার। ছবি: সংগৃহীত
ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্র
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ইউক্রেন অভিযানে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার অস্ত্র ব্যবহার করছে রাশিয়া। উত্তর-পূর্বের একটি বেসামরিক প্রি-স্কুলে ক্লাস্টার বোমা হামলা হয়েছে বলে দাবি করেছে অ্যামনেস্টি।