ইরানে সম্মান রক্ষার নামে কিশোরী স্ত্রীকে হত্যার পর তার বিচ্ছিন্ন করা মাথা নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন এক স্বামী। এমন নির্মম ও বীভৎস হত্যাকাণ্ডে তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশজুড়ে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীর সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতের দাবি ফের আলোচনায় উঠে এসেছে।
গত সপ্তাহজুড়ে ইরানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় ফলাওভাবে প্রচারিত হয়েছে ভয়াবহ এই ঘটনাটি।
হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৭ বছর বয়সী ওই কিশোরী গৃহবধূর নাম মোনা গাজাল হেইদারি।
১২ বছর বয়সে পারিবারিকভাবে মোনার বিয়ে হয়েছিল তার চাচাতো ভাই সাজ্জাদ হেইদারির সঙ্গে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মোনাকে বিয়ের পর থেকেই নানাভাবে নির্যাতন করতেন তার স্বামী।
পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে মোনার স্বামী ও দেবর তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করেন। এক হাতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি আর অন্য হাতে স্ত্রীর কাটা মাথা নিয়ে উৎফুল্লভাবে রাস্তায় হেঁটে বেড়ান স্বামী সাজ্জাদ।
সাজ্জাদ হেইদারির অভিযোগ, স্ত্রী অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছিলেন তিনি। তাই সমাজে নিজের সম্মান ফিরে পেতে এমন হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি খুজেস্তান প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আহভাজে এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে প্রথম দিকে প্রশাসনের ঠিলেঠালা ভাব থাকলেও পরে ব্যাপক নিন্দা ও সমালোচনার মুখে ওই দুজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সোমবার তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দেশ ইরানে এমন হত্যাকাণ্ডের জন্য হয়তো এই স্বামীকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাভোগ করতে হতে পারে। পুরুষবান্ধব আইনের কারণেই মৃত্যুদণ্ড এড়িয়েও যেতে পারেন এই পাষণ্ড স্বামী।
এমন সহিংসতা বন্ধে পার্লামেন্টকে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির নারী ও পরিবারবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট এনসিয়েহ খাজালি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ও জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর নির্দেশ দেন তিনি।
২০২০ সালে পারিবারিক সম্মান রক্ষার অজুহাতে ১৪ বছর বয়সী রোমিনা আশরাফির মাথা বিচ্ছিন্ন করেছিলেন তার বাবা। কন্যা হত্যার অপরাধে বাবাকে কেবল ৯ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত
দেশটির জিলান প্রদেশে ২০২০ সালে পারিবারিক সম্মান রক্ষার অজুহাতে ১৪ বছরের এক কিশোরীর মাথা বিচ্ছিন্ন করেছিলেন তার বাবা। রোমিনা আশরাফির অপরাধ ছিল সে পরিবারের অমতে প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল।
কন্যা হত্যার অপরাধে বাবাকে কেবল ৯ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়।
মোনা গাজাল হেইদারি বা রোমিনা আশরাফির মতো দেশটিতে পারিবারিক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের শিকার কিশোরীর তালিকা অনেক বড়।
দেশটির নারী ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রতি বছর অন্তত ৩৫০ নারী ও কিশোরী এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। পরিবারের সম্মান রক্ষায় এমন হত্যার শিকার নারীর সংখ্যা মোট হত্যাকাণ্ডের ২০ শতাংশ।
ইরানের আইনে অরক্ষিত নারী
দেশটির ইসলামিক দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা অনুযায়ী, শরিয়া আইনে মৃত্যুদণ্ডের মতো অপরাধ করলে যে কাউকে আইনগতভাবে হত্যা করতে পারেন একজন পুরুষ। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক বা ব্যভিচারের মতো অপরাধ করলে নারীকে হত্যা করার বৈধতা দেয় এই আইন। তবে স্বামী ব্যভিচার করলে তাকে হত্যার বৈধতা দেয় না দেশটির পুরুষতান্ত্রিক আইন ব্যবস্থা।
দেশটির আইন অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডে জড়িত যেকোনো নারী কিংবা পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তবে যদি কোনো বাবা তার সন্তানকে হত্যা করেন সেই অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড হবে না। এমন অপরাধে তাকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হতে পারে। পাশাপাশি তাকে গুনতে হতে পারে অর্থদণ্ড।
করোনায় বাল্যবিয়ে বাড়ায় ঝুঁকিতে কিশোরী বধূরা
ইরানে কয়েক বছর ধরে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এতে দেশটিতে পারিবারিক সহিংসতা ও শিশু-কিশোরী বধূদের স্বামীর হাতে হত্যার ঘটনাও বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে।
বিয়ের খরচ বাবদ মেয়ের পরিবার কম সুদে মোটা অঙ্কের ঋণ সহায়তা পেয়ে থাকে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক থেকে।
দেশটির রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান মতে, এমন ঋণ সহায়তার লোভে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে অন্তত চার গুণ।
ব্যাংক মাসকানের তথ্য মতে, নবদম্পতিকে সাত বছর মেয়াদে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ২৩ হাজার ৭২০ ডলার (১০ কোটি তোমান) ঋণ সহায়তা দেয়া হয়।
করোনা মহামারিতে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো তাদের কন্যাশিশুদের বয়স বাড়িয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে বিশাল অঙ্কের এই ঋণ সহায়তা।
দেশটির পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য মতে, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৯ হাজার ৭৫৩ কন্যাশিশু ও কিশোরীর বিয়ে হয়েছে গত বছরের বসন্তে। এই সংখ্যা ২০২০ সালের বসন্তের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি।