যদি হঠাৎ করে এমন হয়, আপনার ফেসবুক পাসওয়ার্ড উন্মুক্ত হয়ে গেল, কিংবা ক্রেডিট কার্ডের সব টাকা হাওয়া। বিশ্বব্যাপী আমরা যে ডিজিটাল অর্থব্যবস্থা দেখি সেটাই মুখ থুবড়ে পরে গেল। প্রযুক্তিতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকল না। এর থেকেও ভয়াবহ কিছু হতে পারে। যদি এক দেশ আরেক দেশকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বসে। অথচ সেসব দেশের কর্তৃপক্ষও দেখা যাবে, ঘটনা সম্পর্কে অবগত নয়। তখন কী হবে? বিশ্বযুদ্ধ!
ঠিক এমন পরিস্থিতিকেই প্রযুক্তির জগতে বলা হয় ‘কোয়ান্টাম মহাপ্রলয়’।
কিন্তু একবার যদি কার্যকরী কোয়ান্টাম কম্পিউটার আবির্ভূত হয়, তাহলে এই এনক্রিপশনগুলো ভাঙতে সক্ষম হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মালিকেরা। ফলে এটি মুহূর্তেই একটি দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অকেজো করে দিতে পারবে, বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সির ওয়ালেট শূন্য করে দিতে পারবে।
খুব সাধারণভাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয়, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি আমাদের প্রচলিত কম্পিউটার প্রযুক্তি থেকে একেবারে ভিন্নভাবে কাজ করে। তত্ত্বগতভাবে বর্তমান কম্পিউটারের থেকেও লাখ লাখ গুণ বেশি দ্রুত চলতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
ফলে দেখা গেছে, যে সমস্যা সমাধানে বর্তমান যুগের একটি কম্পিউটারের অনেক বছর লেগে যাবে, সেই একই সমস্যা সমাধান করতে ভবিষ্যৎ কোয়ান্টাম কম্পিউটার সময় নেবে মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা কোয়ান্টাম কম্পিউটার মানবিক সব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে। তাই তো যুক্তরাজ্যের মতো দেশ অক্সফোর্ডশায়ারের হারওয়েলের জাতীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সেন্টারে বিনিয়োগ করছে এই গবেষণায় বিপ্লব ঘটানোর আশায়।
কিন্তু এর অন্ধকার দিকও আছে।
ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে সাইবার দুনিয়ার। তাই সাইবার দুনিয়াতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রতিযোগিতা শুরু করেছে পরাশক্তিগুলো। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশ সুপার-ফাস্ট কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিকাশের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে এবং এ খাতে ব্যয় করছে ব্যাপক অর্থ ।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এমনকি আমার ও আপনার ডেটাসহ প্রতিদিন ব্যবহৃত অজস্র এনক্রিপ্টেড ডেটা আমাদের অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন ডেটা ব্যাংকে জমা করা হচ্ছে। যারা এইসব ডেটা চুরি করছে, তারা অপেক্ষা করছে সেই দিনের জন্য, যখন চোরদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই এনক্রিপ্টেড ডেটাগুলো ডিক্রিপ্ট করতে পারবে।
পোস্ট কোয়ান্টাম প্রতিষ্ঠানের সিএসও (চিফ স্ট্রাটেজিক অফিসার) বলেন, ‘আজকের দুনিয়ায় আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যা কিছু করি না কেন, অনলাইনে কেনাকাটা, ব্যাংকিং লেনদেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস গ্রাহকের নিরাপত্তার চিন্তায় প্রায় সবকিছুই এনক্রিপ্টেড করা হয়।
‘কিন্তু একবার যদি কার্যকরী কোয়ান্টাম কম্পিউটার আবির্ভূত হয়, তাহলে এই এনক্রিপশনগুলো ভাঙতে সক্ষম হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মালিকেরা। ফলে এটি মুহূর্তেই একটি দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অকেজো করে দিতে পারবে, বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সির ওয়ালেট শূন্য করে দিতে পারবে।’
ক্যামব্রিজ ও কলোরাডোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টিনুমের সিইও ইলিয়াস খান বলেন, ‘বর্তমান প্রচলিত এনক্রিপশনগুলোর অধিকাংশকেই অচল করে দেবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এই প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রার জন্য হুমকি।’
কিন্তু এত বড় হুমকি। অথচ এ বিষয়ে আমরা কখনো শুনিনি। বিষয়টা অবাক করার মতো।
আমরা শুনে থাকি অথবা না শুনে থাকি, আসল সত্যিটা হলো, আমরা যদি এখনই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হুমকি মোকাবেলায় কোনো পদক্ষেপ না নিই, তবে ভবিষ্যতে অনেক খারাপ কিছুই হবে। এমনটাই মনে করেন হোয়াইট হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
তবে বসে নেই বিশ্ব। ইতিমধ্যে অনেক দেশ কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হুমকিকে মাথায় রেখে কাজ শুরু করেছে। যুক্তরাজ্যের ‘অতি গোপনীয়’ সরকারি ডেটা ইতিমধ্যে ‘পোস্ট-কোয়ান্টাম’ নামের নতুন এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। গবেষকরা আশা করছেন, ‘পোস্ট-কোয়ান্টাম’ এনক্রিপশন সুরক্ষা পদ্ধতি কোয়ান্টাম হুমকি থেকে ডেটাকে সুরক্ষা দেবে।
গুগল, মাইক্রোসফট, ইন্টেল ও আইবিএমের মতো প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে কোয়ান্টাম সুরক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এ ধরনের কাজে গুগল কিছুটা এগিয়ে। কারণ গুগল ইতিমধ্যে কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জন করেছে। এই বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে কোয়ান্টাম মহাপ্রলয় ঠেকাতে কাজ করছে কোয়ান্টিনুম ও পোস্ট-কোয়ান্টামের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসির বাইরে ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এনআইএসটি) পোস্ট-কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির ওপর ‘বিউটি প্যারেড’ হচ্ছে।
এই ‘বিউটি প্যারেড’-এর উদ্দেশ্য হলো একটি মানসম্মত প্রতিরক্ষা কৌশল প্রণয়ন করা। যাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সরকার, একাডেমিয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা কৌশলকে কোয়ান্টাম মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা করা যায়।
এই সব কোনো কিছুই স্বল্প খরচে করা যায় না। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রতিটি শাখা নিয়ে কাজ করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোয়ান্টাম মহাপ্রলয় থেকে রক্ষায় উন্নত পোস্ট কোয়ান্টাম প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ কোয়ান্টাম মহাপ্রলয়কে মোকাবেলা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই।