স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ২৬তম জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে এ বছরের চূড়ান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে প্রায় ২০০ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপজ্জনক প্রভাব ঠেকানোর লক্ষ্যে প্রণীত এ চুক্তিতে উপেক্ষিত হয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলার বিষয়টি।
তবে গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তিই প্রথম, যেখানে পরিবেশ রক্ষায় কয়লার ব্যবহার কমানোর জন্য বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে কয়লার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্মেলনের প্রাথমিক আলোচনার খসড়ায় জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার বন্ধে বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতের বিরোধিতায় মাঝপথেই থমকে যায় সে প্রচেষ্টা।
একই সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থার কথাও উল্লেখ নেই চুক্তিটিতে।
বায়ুমণ্ডলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের গ্যাস নিঃসরণ কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হলেও নেয়া হয়নি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাড়তি অর্থসহায়তা দেয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে বিশ্বসম্প্রদায়।
চুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়নে অব্যাহত কাজ করে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ‘সামনের বছরগুলোতে আরও অনেক কাজ করতে হবে আমাদের। সে পথে গ্লাসগো চুক্তি একটি বড় পদক্ষেপ।
‘কয়লার ব্যবহার কমানোর এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি পেয়েছি আমরা।’
যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ুবিষয়ক দূত ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেন, ‘জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এবং বিশুদ্ধ বাতাস, নিরাপদ পানি ও পৃথিবীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বিশ্ব।’
তবে জনসন কিংবা কেরির মতো আশাবাদী নন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রহ এক ভগ্নদশার মধ্যে রয়েছে। আর এক পা পরই গভীর খাদ। অথচ এখনও আমরা জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে শুধু আলোচনাই করে যাচ্ছি।
‘জরুরি অবস্থা ধরে নিয়ে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সময়। না হলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন শূন্যে নামানোর সম্ভাবনাই শূন্যের কোঠায় নেমে যাবে।’
গ্লাসগো চুক্তির বাস্তবায়ন হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৪ ডিগ্রিতে সীমিত রাখা সম্ভব হতে পারে। আর দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে কার্বনের বড় উৎসগুলো বন্ধে করণীয় নির্ধারণে আগামী বছর আলোচনায় বসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বসম্প্রদায়।
বিজ্ঞানীদের মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা না গেলে চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে পৃথিবী। তীব্র গরমে খরা আর হিমবাহ ও বরফের আস্তর গলে নামা পাহাড়ি ঢল ও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট বন্যায় ভুক্তভোগী হবে কোটি কোটি মানুষ।
এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি খাতে কয়লার ব্যবহার বন্ধে গ্লাসগো চুক্তিতে জোরালো পদক্ষেপ না থাকলেও আশা হারাতে রাজি নন অনেক পর্যবেক্ষক। তারা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও গ্লাসগো চুক্তি নতুন আশার আলো। কারণ জাতিসংঘের এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কোনো নথিতে সুনির্দিষ্টভাবে কয়লার উল্লেখ এবারই প্রথম।
প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, তার প্রায় ৪০ শতাংশের জন্য দায়ী কয়লা। তাই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে রাখার বিষয়ে আলোচনা কেন্দ্রে এই জীবাশ্ম জ্বালানি।
এমন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কমানোর কথা বলা হয়েছিল। ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়েও আশা জানানো হয়েছিল।
কিন্তু পরের ছয় বছরে সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের ধারেকাছেও পৌঁছায়নি বিশ্ব।