এক পাশে একটি সাইকেলের দোকান, অন্যপাশে একটি কফি হাউস। এর মাঝখানে থাকা একটি দোকানে ভিড় জমিয়েছে বেশ কিছু মানুষ। পশ্চিম লন্ডনের এই মানুষগুলোকে দুর্ভাগ্যবান বললেও ভুল হবে না। কারণ তারা জড়ো হয়েছেন বিনামূল্যের খাবার খেতে।
বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করা ওই দোকানটির নাম- ডেড’স হাউস। খাঁটি বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘বাবার হোটেল’। বাবার হোটেলের মত এখানেও খাবার খেতে কোনো পয়সা লাগে না।
পাশ্চাত্যে এ ধরনের ব্যবস্থাকে বলা হয়- ফুড ব্যাংক। যুক্তরাজ্যজুড়ে প্রায় ২২০০ ফুড ব্যাংক এখন চালু রয়েছে। ডেড’স হাউস তাদেরই একটি।
ডেড’স হাউসের প্রতিষ্ঠাতা বিলি ম্যাকগ্রানাঘান। সম্প্রতি তার ফুড ব্যাংকে হাজির হয়েছিল সিএনএন বিজনেসের একটি দল।
দোকানে আসা মানুষদের সম্পর্কে সিএনএনকে বিলি বলেন- ‘তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার।’
ডেড’স হাউসে এক অভাবী মানুষ
লন্ডনের ফুড ব্যাংকগুলোতে জরুরি খাদ্য সহায়তা চাওয়া মানুষের ভিড় মহামারির আগে থেকেই বাড়তে শুরু করেছিল। এর ওপর এবার মহামারির দ্বিতীয় শীতকাল পাড়ি দিতে চলেছে এই শহর। ইতোমধ্যেই মহামারির প্রভাব পড়েছে বাজারে। বেড়ে গেছে খাবারের দাম। জ্বালানির খরচও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। এর মধ্যেই আবার বন্ধ হয়ে গেছে মহামারিকালীন সরকারি সুযোগ সুবিধাও। তাই সংসার চালাতে অসংখ্য পরিবারের বাজেট এখন ফেইল করছে। ফলশ্রুতিতে বিনামূল্যের খাবারের জন্য এখন লাইন বাড়ছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই লন্ডনের ফুড ব্যাংকগুলোতে অনাহারী মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো টুকি-টাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এখন এসব ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন।
ডেড’স হাউসের প্রতিষ্ঠাতা বিলি ম্যাকগ্রানাঘান জানান, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে তার ফুড ব্যাংকে নতুন করে আরও ৭০ জন সাহায্যপ্রার্থী যুক্ত হয়েছেন। সপ্তাহে প্রায় চার শতাধিক মানুষকে এখন তার ফুড ব্যাংক থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন মানুষ যুক্ত হওয়ার এই প্রবণতা অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি দেখা যাচ্ছে।
বিলির মতে, তার দোকানে আসা মানুষদের খালি চোখে দেখলে মনেই হবে না যে তারা এতটা অভাবী হয়ে পড়েছেন। তাদের এমন অবস্থা অবশ্য এর আগে কখনও ছিল না।
মহামারির সময় ডেড’স হাউস থেকে সাধারণত শিক্ষক, গ্রাফিক ডিজাইনার এবং সাংবাদিকদের সহযোগিতা করা হতো। স্থানীয় প্রশাসনের রেফারেন্স কিংবা অনলাইনে যারা সাহায্য প্রর্থনা করেছিলেন তাদেরকেই সহযোগিতা করা হয়েছে। কিন্তু এখন এই ফুড ব্যাংকে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এমন অভাবী মানুষের সংখ্যা বাড়ার কারণ হিসেবে গ্যাস, বিদ্যুৎ তথা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকেই দায়ী করেছেন বিলি।
ডেড’স হাউস থেকে যারা নিয়মিত সহযোগিতা নিচ্ছেন তাদের মধ্যে ৬৩ বছর বয়স্ক ম্যারি একজন। নিজের পদবি প্রকাশে অনিচ্ছুক ম্যারি জানান, চার মাস ধরে তিনি ডেড’স হাউসের জরুরি সহযোগিতা নিচ্ছেন। কিন্তু এখন আসন্ন ত্রৈমাসিক জ্বালানি বিল নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছেন। তার স্বামীর রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা রয়েছে। তাই জ্বালানি ব্যবহার করে ঘরকে সবসময় গরম রাখতে হয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা খুব বেশি খাইনা। বলা যায়- বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই। কিন্তু দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়েছে জ্বালানির দাম, যা কমছেই না, কমছেই না…।’
ডেড’স হাউস থেকে প্রায় সাত মাইল পূবে গিয়ে আরও একটি ফুডব্যাংকের সন্ধান পায় সিএনএন বিজনেস টিম। সেই সন্ধ্যায় প্রায় ১০০ জন মানুষের জন্য মিস্টি কুমড়োর গরম স্যুপের আয়োজন করেছিল ব্যাংকটি। এটির প্রতিষ্ঠাতা ৪২ বছর বয়স্ক রবার্ট হানিঙ্ঘার। হামডিঞ্জারস নামে তার একটি খাবারের দোকান রয়েছে। এই দোকানেরই আরেকটি অংশ হলো- হামডিঞ্জারস ফুড ব্যাংক। গত বছর চালু করা এই ব্যাংক থেকে লকডাউনের দিনগুলোতে প্রায় সহস্রাধিক মানুষকে জরুরি খাদ্য সহযোগিতা দেয়া হয়েছে।
রবার্ট জানান, তার ফুড ব্যাংকে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে বিনামূল্যে খেতে আসা মানুষের সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। এদের মধ্যে তরুণ কর্মজীবী মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন স্কুলশিক্ষক, এমনকি টেনিস খেলোয়াড়ও।
হামডিঞ্জারস স্যুপ কিচেনে আসা মানুষদের তদারকি করছেন এই ফুড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট হানিঙ্ঘার
রবার্ট বলেন, ‘চাকরিজীবীরাও এখানে আসছেন। কারণ তারা জীবন-যাত্রার ব্যায় বহন করতে এখন হিমশিম খাচ্ছেন। দাম বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুই এখন তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।’
যুক্তরাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ ফুড ব্যাংকে মুদি পণ্য সরবরাহ করা ট্রাসেল ট্রাস্টের নীতি ও গবেষণা পরিচালক গ্যারি লেমন জানান, তাদের কর্মীরা এখন জরুরি খাদ্য সহযোগিতা নিতে আসা মানুষদের পেছনে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ক্রিসমাসকে সামনে রেখে সামনের সপ্তাহগুলোতেও তারা এই সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে চান।
সিএনএন বিজনেসের প্রতিবেদনটিতে যুক্তরাজ্যের মানুষের এমন পরিণতির জন্য জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কথাই বলা হয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে সেখানে গ্যাসের পাইকারি মূল্য ৪২৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। জ্বালানির এই দাম বৃদ্ধির জন্য বেশ কয়েকটি কারণকেই এখন দায়ী করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি কারণ হলো- এশিয়ার দেশগুলোতে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি এবং অন্য আরেকটি কারণ হলো- প্রত্যাশা অনুযায়ী রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি না করা।
এর ফলে যুক্তরাজ্যের শক্তি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানির দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। চলতি মাসের প্রথম দিনই বেশিরভাগ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রতি ইউনিট জ্বালানির দাম ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে, যা প্রায় দেড় কোটি মানুষের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
খাদ্য ও জ্বালানিমূল্য বেড়ে যাওয়ার প্রভাব যাদের ওপর গুরুতরভাবে পড়েছে, ডেড’স হাউসে উপস্থিত হওয়া ৪৯ বছর বয়সী জেমসন কেয়ান তাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিজের মায়ের দেখ-ভাল করতে হয় এই আর্টিস্টকে। মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ডেড’স হাউস থেকে তিনি নিয়মিত খাদ্য সহায়তা নিচ্ছেন।
জেমসন বলেন, ‘আমার বাজেট সপ্তাহে ১০০ পাউন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আজকাল এই অর্থ যেন নিমেষেই খরচ হয়ে যাচ্ছে।’
জেমসন জানান, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন তার জ্বালানি খরচ বেশি। যদিও আগে যতটুকু জ্বালানি ব্যবহার করতেন, এখনও ঠিক ততটুকুই করছেন।
তার ধারণা, জ্বালানি বাবদ তার যত টাকা খরচ হয়, গত দুই সপ্তাহে সেই খরচ এক তৃতীয়াংশ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে, গ্যাসের দাম।
জ্বালানির উচ্চমূল্য পুরো ইউরোপজুড়েই দেখা যায়। কিন্তু সঞ্চিত গ্যাস না থাকায় যুক্তরাজ্যে এই বাজারটি আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। তাই আসন্ন শীতে যুক্তরাজ্যের মানুষ খাবে নাকি নিজেকে গরম রাখবে তা নিয়েই এখন সংশয়ে আছে।