পূর্ব জেরুজালেম থেকে শুরু হয়ে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে ছড়িয়ে পড়া এই সাম্প্রতিক সহিংসতার পেছনে রয়েছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক স্বার্থ।
আল জাজিরায় প্রকাশিত মতামতে ইসরায়েলের লেখক ও কলামিস্ট আকিভা ইলডার জানান, বিরোধী দলগুলোর নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে ও ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির প্রতি বিষোদগার জনগণের মনোযোগ জাতীয়তাবাদের প্রতি ঘুরিয়ে দিতে এমন সংঘাতকে উসকে দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
নেতানিয়াহুর একাধিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং যারা নেতানিয়াহু ও তার দল কট্টর ডানপন্থি লিকুদ পার্টিকে বাদ দিয়ে নতুন সরকার গঠনে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ অন্তত দুমাস আগে থেকেই দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এমন চতুর ও ঘৃণ্য রাজনৈতিক ফন্দির বিষয়ে জনগণকে সতর্ক করেছিলেন।
সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বিরোধী দল ইয়েশ আতিড পার্টির চেয়ারম্যান ইয়ার ল্যাপিড গত ২৩ মার্চের নির্বাচনে নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির পরাজয়ের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এমন দুরভিসন্ধির বিষয়টি নিয়ে জনগণকে সতর্ক করেছিলেন।
সাদা ও নীল জোটের (হোয়াইট অ্যান্ড ব্লু অ্যালায়েন্স) চেয়ারম্যান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজের সঙ্গে এক বৈঠকে ইয়ার ল্যাপিড বলেন, ‘আপনাকে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। নেতানিয়াহু যদি মনে করেন, ক্ষমতা তার হাতের মুষ্টি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তাহলে তিনি গাজা অথবা উত্তর সীমান্তে একটি নিরাপত্তাবিষয়ক জাতীয় ইস্যু তৈরি করবেন। যদি তিনি মনে করেন এমন সংকটই তাকে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করবে, তবে তিনি যেকোনো ধরনের সংকট তৈরি করতে এক মুহূর্তের জন্যেও শঙ্কিত হবেন না।’
নতুন জোট গঠনে নেতৃত্বদানকারী ও দেশটির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালুন জানান নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে গাজার চলমান সংহিসতার সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে। এই নিরাপত্তাবিষয়ক সংঘাত নেতানিয়াহুর পাশাপাশি হামাসের জনপ্রিয়তাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরেক সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বিরোধী দল ইয়াসরায়েল বেইতেনুর চেয়ারম্যান অভিগডোর লাইবারম্যান বলেন, ‘গাজায় চালানো এই সামরিক অভিযানের কৌশলগত উদ্দেশ্য হচ্ছে নেতানিয়াহুর প্রতি শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলা।’
লাইবারম্যান অভিযোগ করেন, ফিলিস্তিনের তরুণদের আন্দোলনের অন্যতম স্থান দামাস্কাস গেটটি নেতানিয়াহু গত মাসে বন্ধ করে দিতে পারতেন। তবে তিনি তা সচেতনভাবে এড়িয়ে যান। এবং এ গেটটিকে কেন্দ্র করে হাজারো ফিলিস্তিনি তরুণদের একত্রিত হতেও বাধা দেননি তিনি।
লাইবারম্যান এ সময় প্রশ্ন তোলেন কেন নেতানিয়াহু দামাস্কাস গেটে ফিলিস্তিনি যুবকদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর সংঘর্ষ রোধে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নেননি? কেন তিনি ফিলিস্তিনিদের সেখানে জড়ো হতে বাধা দেননি? কেন তিনি আল-আকসা মসজিদের ভেতরে ইসরায়েলি পুলিশকে গ্রেনেড ছুড়ে মারার অনুমতি দিয়েছিলেন?
লাইবারম্যান আরও বলেন, ‘ নিজের স্বার্থেই সংঘাত নিরসনে নেতানিয়াহু কোনো রকমের আগাম পদক্ষেপ নেবেন না। তার বিরোধী জোটের প্রতি মানুষের মনোযোগ হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এমন সহিংসতা চালিয়ে যেতে চাইবেন।’
সহিংসতার কয়েক দিন পর রোববার দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দেন, গাজা উপত্যকায় চালানো ইসরায়েলের বিমান হামলা পুরোদমে অব্যাহত থাকবে। এবং এমন জোরালো হামলা দীর্ঘ সময় ধরে চলবে।
প্রায় ১২ বছর ক্ষমতায় থাকা নেতানিয়াহু গত দুই বছর নিজের রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। গত ২৪ মাসে তার সংখ্যালঘু দল চারবার নির্বাচনে অংশ নিয়েও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
একই সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গেও ঐক্যজোটের সরকার গঠনেও ব্যর্থ হন তিনি। এ সময় তিনি দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত হন। তিনি এবার ক্ষমতা থেকে সরে গেলে তাকে কারাগারে পাঠানো হতে পারে।
নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে ল্যাপিড ও গ্যান্টসের নেতৃত্বে লেবার পার্টি, ইয়ামেনি পার্টি, নিউ হোপসহ অন্তত আটটি ছোট-বড় দল জোটবদ্ধ হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আদেশ পেয়ে তারা নেতানিয়াহু ও তার লিকুদ পার্টিকে বাদ দিয়ে সরকার গঠনে কাজ করছে। চলতি মাসেই শেষ হতে যাচ্ছে নতুন সরকার গঠনের এই সময়সীমা।
জোটটি খুব বেশি শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ না হলেও নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে একমত হয়েছেন পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসা নতুন এই রাজনৈতিক জোটের নেতারা।