বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে পরিচিত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার উত্তর ও পূর্বে ৫১ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে ইসরায়েলের সীমান্ত। দুর্ভেদ্য এ সীমান্ত ভেদ করে ইসরায়েলের যেকোনো হামলার পাল্টা জবাব দেয়া প্রায় অসম্ভব। এমন বাস্তবতায় গাজার শাসক দল হামাস বিভিন্ন স্থান থেকে সীমান্তবর্তী এলাকা পর্যন্ত অসংখ্য টানেল বা সুড়ঙ্গ বানিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়।
এর বাইরে মিসর সীমান্ত দিয়ে মালামাল, অন্য সরঞ্জাম আনতেও ব্যবহার করা হয় টানেলগুলো। শুধু হামাস বা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নয়, জীবনের প্রয়োজনে সাধারণ লোকজনও টানেল বানিয়ে পণ্য আনা-নেয়া করে।
পশ্চিমাদের ধারণা, ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের উপত্যকায় ইসরায়েল আকাশ থেকে যেকোনো হামলা চালালে টানেল থেকেই গোপন কার্যক্রমের উল্লেখযোগ্য অংশ চালায় হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। আর এ কারণেই এসব টানেল নিয়েই আতঙ্কে থাকে ইসরায়েলি সেনাসহ দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।
২০১৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হামাসের অন্যতম কার্যকর যুদ্ধাস্ত্র ছিল এই সুড়ঙ্গগুলো। এখান থেকেই গোপনে অস্ত্র বহন করে ইহুদি রাষ্ট্রে প্রবেশ করত হামাস যোদ্ধারা। ইসরায়েলি সেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে আবার এসব সুড়ঙ্গ হয়েই নিরাপদে গাজা উপত্যকায় ফিরে যেত তারা।
২০০৭ সালে হামাসের প্রথম সুড়ঙ্গটি নির্মাণ করা হয় গাজা উপত্যকা ও মিসরের মাঝামাঝি অংশে। মূলত ইসরায়েলের অবরোধ এড়িয়ে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের জন্য ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সুড়ঙ্গটি নির্মাণের মূল লক্ষ্য ছিল।
অবশ্য ২০০২ সালের দিকেও গাজায় আধা-নির্মিত কিছু সুড়ঙ্গ ছিল। এগুলোর দুটি ব্যবহার করে ২০০৪ সালে ইসরায়েলি সেনা ও নিরাপত্তা চৌকি লক্ষ্য করে দুটি হামলা চালায় হামাস।
সশস্ত্র সংগঠনটি প্রথমবার সুড়ঙ্গপথে সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাস প্রবেশ করে ২০০৬ সালে। সে সময় এক ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ করে গোষ্ঠীটি, আটকে রাখে পাঁচ বছরেরও বেশি সময়।
২০১৩ সাল নাগাদ মিসর সীমান্ত থেকে সরিয়ে সুড়ঙ্গগুলোর নতুন গন্তব্য হয় ইসরায়েল। সে সময় ইসরায়েল-গাজা সীমান্তে কমপক্ষে তিনটি সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে দুটি সুড়ঙ্গ বিস্ফোরকে বোঝাই ছিল।
হামাসসহ গাজার ইসলামপন্থি বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে সুড়ঙ্গে তাদের সংগৃহীত ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট, গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখে। যোদ্ধাদের গোপন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয় সেগুলো।
এমন পরিস্থিতিতে পুরো সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছিল ইসরায়েল। উন্নত গোয়েন্দা প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনী থাকা সত্ত্বেও বারবারই ভেস্তে যাচ্ছিল সব প্রচেষ্টা।
এর কারণ হিসেবে বলা হয়, তিন কোটি থেকে নয় কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত এসব সুড়ঙ্গ আকাশ থেকে শনাক্ত করা ভীষণ কঠিন।
৩৬টির বেশি সুড়ঙ্গের কয়েকটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের শেষ দিকে। শুধু সেগুলোরই খরচ ৩০ লাখ ডলারের বেশি।
বিমান হামলা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করেই এসব সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
সুড়ঙ্গের ভেতরের ছবিতে দেখা যায়, স্যাঁতস্যাঁতে ভ্যাপসা পরিবেশের নিচু সুড়ঙ্গগুলোতে যোদ্ধাদের সোজা হয়ে দাঁড়ানোরও সুযোগ নেই।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে প্রথম সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালায় হামাস। সে সময় হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া বলেছিলেন, ইসরায়েলি অবরোধ ও আগ্রাসন মোকাবিলায় নতুন কৌশলে এগোচ্ছে গোষ্ঠীটি।
মূলত ২০১৪ সালের জুনে তিন ইসরায়েলি কিশোরকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযান শুরু হয়। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল-হামাস সহিংসতা চলে সাত সপ্তাহ।
সে সময়েও ইসরায়েলের হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল হামাসের সুড়ঙ্গ ধ্বংস করা। এ লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল ‘অপারেশন প্রটেকটিভ এজ’। ওই অভিযানে ৩২টি সুড়ঙ্গ ধ্বংসের দাবি করেছিল তেল আবিব, যার ১৪টিই ইসরায়েলে প্রবেশ করেছিল।
২০১৪ সালের ওই ভয়াবহ সহিংসতায় দুই হাজার ২৫১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। আহত হয় ১০ হাজারের বেশি। গৃহহীন হয় এক লাখের বেশি মানুষ। ছয় সেনাসহ ৭৪ ইসরায়েলিও নিহত হয় ওই যুদ্ধে।
সে যুদ্ধে ধ্বংস করে দেয়া ৩২টি সুড়ঙ্গই গত সাত বছরে হামাস পুনর্নির্মাণ করেছে বলে ধারণা করা হয়।
আত্মরক্ষার জন্য সুড়ঙ্গগুলো তৈরির কথা বলা হলেও ২০১৫ সাল থেকে সুড়ঙ্গ নির্মাণে গতি আনতে বুলডোজার, ট্রাক্টর ও নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার শুরু করে হামাস। এতে অর্থায়নের সিংহভাগই ইরান থেকে এসেছিল বলে ধারণা করা হয়। এমনকি হামাসকে রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহও ইসরায়েলের অন্যতম শত্রু রাষ্ট্রটি করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
মিসরীয় সেনাবাহিনী ২০১৬ ও ২০১৭ সালে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে দেয়। তারা ৫৪ জন হামাস সদস্যকে হত্যা করে।
২০১৮ সালে হামাসের নির্মাণ করা দীর্ঘতম ও সবচেয়ে গভীর সুড়ঙ্গটির সন্ধান ও ধ্বংসের দাবি করে ইসরায়েল। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, গাজা উপত্যকা থেকে শুরু করে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গটি ইসরায়েলের ভেতরে গিয়ে শেষ হয়েছিল। সেটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল কয়েক কোটি ডলার।
সে সময় থেকেই সুড়ঙ্গপথে হামাস যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আরও কৌশলী হয় ইসরায়েল। সীমান্তে মাটির গভীরে দেয়াল নির্মাণে নেয়া হয় ৩০০ কোটি ডলারের প্রকল্প। ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে সেটি নির্মাণ শুরু হয়, শেষ হয় চলতি বছরের মার্চ মাসে।
আট মিটার উঁচু ও ৪১ মাইল দীর্ঘ কংক্রিটের তৈরি ওই দেয়ালে ‘মোশন সেন্সর’ নামে এক ধরনের যন্ত্র স্থাপন করা হয় যা সুড়ঙ্গ খোঁড়ার চেষ্টা হলেই তা শনাক্তে সক্ষম।
২০২০ সালের অক্টোবরেই এর সাফল্যও প্রমাণ হয়। গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস থেকে খনন হয়ে আসা একটি সুড়ঙ্গ শনাক্ত হয় মোশন সেন্সরের মাধ্যমে।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার রাতভর বোমা হামলার উদ্দেশ্যই ছিল সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করে দেয়া।
হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমান, সাঁজোয়া নৌযান নিয়ে গাজার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে এক হাজারের বেশি বোমা ফেলে ইসরায়েলি বাহিনী।
সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, অনেকটা চালাকি করেই বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে গাজায় হামলার ঘোষণা দেয় ইসরায়েল। এতে নিরাপত্তার জন্য হামাস যোদ্ধাদের অনেকেই মাটির নিচের সুড়ঙ্গে আশ্রয় নেয়। এরপরই সেখানে একযোগে বহুমুখী আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী।