বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কলকাতায় প্রতিমা শিল্পীদের বাঙাল-ঘটি লড়াই

  • তরুণ চক্রবর্তী, কলকাতা   
  • ১৮ অক্টোবর, ২০২০ ০৮:৩৪

উভয় পাড়ের শিল্পীরাই কুমোরটুলির গর্ব। একপক্ষ আধুনিক বিচিত্র ভাবনায় ফুটিয়ে তোলেন প্রতিমা। আরেক পক্ষ এখনও সাবেকিয়ানাতেই ভরসা রেখে তুলে ধরছেন নিজেদের উৎকর্ষ।

করোনাকালেও কলকাতার কুমোরটুলি ব্যস্ত বাঙাল-আর ঘটির শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে। এপার আর ওপারের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি গঙ্গার পাড়ে মৃৎশিল্পীদের পাড়ায় কান পাতলেই শোনা যায়। অথচ দুপক্ষই বহিরাগত। একপক্ষ বাঙাল। তাঁরা এসেছেন পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে। আরেক পক্ষ এসেছে কলকাতা থেকে প্রায় ১০০ কিমি দূরের কৃষ্ণনগর থেকে।

উভয় পাড়ের শিল্পীরাই কুমোরটুলির গর্ব। একপক্ষ আধুনিক বিচিত্র ভাবনায় ফুটিয়ে তোলেন প্রতিমা। আরেক পক্ষ এখনও সাবেকিয়ানাতেই ভরসা রেখে তুলে ধরছেন নিজেদের উৎকর্ষ।

বাঙাল-ঘটির লড়াই থাকলেও কুমোরটুলির শিল্পীরা নিজেদের এলাকার সুনাম ধরে রাখতে সচেষ্ট।

উত্তর কলকাতার শোভাবাজারের কাছে রবীন্দ্র সরণীর পাশ দিয়ে গলিপথে কুমোরটুলি। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত প্রতিমা তৈরির ঠিকানা। শুধু কলকাতা কেন, দূর দূরান্ত থেকে এখানে মানুষ আসেন মূর্তি নিতে। বাংলাদেশে তো বটেই, সাতসমুদ্র তের নদী পার করে পাশ্চাত্যেও যায় এখানকার প্রতিমা।

একটু ভুল হলো। যায় নয়। যেতো। করোনার থাবা বসেছে কুমোরটুলিতেও। পূজার আর হাতে গোনা কয়েকটা দিন বাকি। কিন্তু সেই ব্যস্ততাটাই উবে গিয়েছে ৩০০ বছরের পুরনো মৃৎশিল্পের পাড়া থেকে। চারি দিকে নিস্তবদ্ধতা।

অন্য বছর এই সময় দম ফেলারও ফুসরত পেতেন না এখানকার শিল্পীরা।  এবার ছবিটা ভিন্ন। তাই প্রতিটি স্টুডিওতে লেখা, করোনাকালে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

আসলে তাঁদের মন ভালো নেই। প্রতিমা গড়ছেন ঠিকই, কিন্তু আগের মতো নিজেদের শিল্পীপ্রতিভা ফুটিয়ে তোলার সুযোগ কম।

সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় গঙ্গার পাড়ে মাটির জিনিস তৈরি দিয়ে যাত্রা শুরু কুমোরপাড়ার। তারপর শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণের অনুরোধে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মৃৎশিল্পীদের পাঠালেন এখানে দুর্গা প্রতিমা বানাতে।

তারপর কুমোরটুলিই হয়ে উঠল কলকাতার দুর্গা প্রতিমা বানানোর সেরা ঠিকানা। এরপর দেশভাগের হাত ধরে পূর্ববঙ্গ থেকেও শিল্পীরা এসে যোগ দিলেন কুমোরটুলিতে। আরও সমৃদ্ধ হলো এখানকার প্রতিমা। গোটা বাংলাতেই ছড়িয়ে পড়ল সুনাম। কুমোরটুলির দুর্গা মানেই হয়ে উঠল লা-জবাব! বিমানে চেপে প্রতি বছর বিদেশ বিভূঁই দুর্গার যাত্রা এখন সাধারণ ব্যাপার।

কুমোরটুলির শিল্পীরা বহুদিন ধরেই দু-ভাগে বিভক্ত। নিজেদের মধ্যে লড়াই না থাকলেও রয়েছে প্রতিযোগিতা। প্রথম পক্ষ কৃষ্ণনগর থেকে আসা শিল্পীরা। তাঁরা থিম ভিত্তিক প্রতিমা বানাতে ওস্তাদ। অর্থাৎ দুর্গাকে আধুনিক সাজে সাজিয়ে তুলে বিষয়-ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়াতেই তাঁদের পারদর্শিতা। সুক্ষ্ম কাজের জন্য বিখ্যাত তাঁরা।

অন্য পক্ষ আবার ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। দুর্গার প্রতিমাকে তাঁরা অসাধারণ শিল্পগুণে করে তোলেন আকর্ষণীয়।

উভয় পক্ষের ঘরানা আলাদা। কিন্তু তেমন বিবাদ নেই। রাজনীতিকে কোনো পক্ষই কুমোরটুলির চৌহদ্দি ডিঙাতে দিতে নারাজ। এমনকী এক সময় পূর্ববঙ্গের বাসিন্দাদের প্রতিও ঘটিদের কোনো ক্ষোভ নেই। কারণ এখন তো সকলেই ভারতীয়। তাই বিরোধের জায়গাও কম।

তবু কুমোরটুলি বাঙাল-ঘটিতেই বিভক্ত। বহুকাল ধরে এখানে ছিল শিল্পীদের দুটি সংগঠন। একটি ঘটিদের কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সাংস্কৃতিক সমিতি। অন্যটি বাঙালদের কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সমিতি। ঘটিদেরটা ভেঙে তৈরি হয়েছে আরও একটি সমিতি। সেটি হলো কুমোরটুলি প্রগতিশীল মৃত্ শিল্প ও সাজ শিল্প সমিতি।

কুমোরটুলি মৃত্শিল্পী সাংস্কৃতিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক রঞ্জিত সরকার বলেন, ‘বাঙাল-ঘটি দুই ঘরানার শিল্পীই কুমোরটুলির অহঙ্কার। বাঙালরা বড় কাজ ভালো করেন। আমরা আবার সুক্ষ্মকাজে এগিয়ে।‘

প্রগতিশীলের সম্পাদক লক্ষ্মণ পালের মতে, ‘থিম পূজায় সবচেয়ে এগিয়ে ঘটিরাই। কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মাটির কাজ আমাদের শিল্পীদের হাতেই ফুটে ওঠে।’

আবার কলকাতায় জন্ম হলেও পূর্বপুরুষের কারণে বাঙাল মৃৎশিল্পী সমিতির কার্যকরী সভাপতি নারায়ণচন্দ্র রুদ্রপালের দাবি, ‘কলকাতার বড় বড় পূজা মন্ডপগুলির শোভা তো আমরাই বাড়িয়ে চলেছি। ভালো প্রতিমা মানেই তো আমাদের শিল্পীদের গড়া মূর্তি।’

বাঙাল-ঘটির লড়াই ছিল, আছে এবং থাকবেও। কিন্তু সেটা প্রতিযোগিতাতে আটকে আছে। কখনওই কোনো গোলমাল হয়নি কুমোরটুলিতে। এবারেও করোনাকালে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সকলেই একজোট। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও। তাই বাঙালরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন এখানকার কিংবদন্তি শিল্পী পরিমল পাল, দীপঙ্কর পাল, নবকুমার পাল, মলয় পালদের। আবার উল্টো দিক থেকেও সম্ভ্রমের সঙ্গে স্মরণ করা হয় রাখাল পাল, নেপাল পাল, মোহনবাঁশি রুদ্রপাল, সনাতন রুদ্রপালদের। উভয় পক্ষই বিশ্বাস করেন, মৃৎশিল্প সাধনায় কারও অবদানই তুচ্ছ নয়।

তবু রয়ে গেছে বাঙাল-ঘটির অহঙ্কার। কলকাতার ইস্টবেঙ্গল জিতলে বাঙালরা খুশিতে ইলিশের দোকানে উঁকি মারেন। আবার মোহনবাগান জিতলে ঘটিদের মন ছোটে চিংড়ির বাজারে। ইলিশ আর চিংড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকলেো সংঘাত নেই কুমোরটুলির শিল্পী মনে।

এ বিভাগের আরো খবর