ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। খাবার কমিয়ে দিয়ে কিংবা সামান্য ব্যায়াম করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, কিন্তু সংযম ছেড়ে দেয়ার পর আবার আগের অবস্থায় ফিরেছে।
ওজন বাড়া নিয়ে যারা এমন সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ইশরাত জাহান স্বর্ণা। তার ভাষায় সেগুলো তুলে ধরা হলো নিউজবাংলার পাঠকদের সামনে।
পয়ত্রিশোর্ধ কর্মজীবী নারী। চলনে-বলনে আধুনিকা, মাথায় একরাশ কালো চুল। বয়স ত্রিশের কোঠায় যাওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে বেড়ে চলেছে ওজন।
পেটটা বেশ বড় হয়ে গেছে দেখে সবাই বলে, ‘দু-বাচ্চার মা হয়েছো, এমন তো হবেই।’ এর সঙ্গে যোগ হলো অনেকটুকু ক্লান্তি, মেজাজ খিটমিট, দিনে রাতে অবসাদ, ঘুমে নেই শান্তি, ঘুম শেষে বিরক্ত। স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক আন্তরিকতার মুহূর্তগুলোও কেমন পানসে হয়ে উঠেছে।
জীবন নিয়ে সচেতনতাই তাকে নিয়ে আসে আমার কাছে। কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা হলো সবই বেশ ভালো। জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তনে তাকে উৎসাহ দেয়া হলো।
বেশ আগ্রহ নিয়ে ফুড প্ল্যান নিলেন। নিলেন প্রায় চল্লিশ মিনিটের কাউন্সেলিং সেশন, যেখানে মূলত মাইন্ডফুলনেসকে প্রাধান্য দেয়া হলো, অনুরোধ করা হলো এক মাস পরেই পুনরায় সাক্ষাতের। সেই সাক্ষাতে তিনি এলেন প্রায় ছয় মাস পর। এসেই অভিযোগ করছেন ওজন কমিয়ে ফেলেছেন ৬ কেজি, তবে ভীষণ হারে পড়ছে মাথার চুল।
পারিবারিক নানা জটিলতায় চিকিৎসক সমীপে না এলেও তিনি নিজ বুদ্ধিতে খাবার কম- বেশি করেছেন। যেমন: ভাত খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, তবে টুকটাক নাশতা (সিঙ্গাড়া, পুরি, কুকিস) তো খাওয়া হয়েই যায়। আবারও নতুন ফুড প্ল্যান এবং কাউন্সেলিং, যেখানে মূলত ফোকাস করা হলো উনার ভুল জীবনযাপন এবং সঠিক খাবার চিনে খেতে না পারা।
সঠিক খাবার নির্বাচন হোক আপনার ফিটনেস জার্নির পাথেয়।
ভাত আমাদের বাঙালিদের অন্যতম প্রধান খাদ্য। ভাত সারা দিনের কাজের শক্তি জোগায়। ভাতের পুষ্টিগুণও অনেক।
শ্রমজীবী মানুষদের দেখবেন, তারা শুধুই ভাতের ওপর একদম নীরোগ এবং পেশিবহুল শরীর নিয়ে বেঁচে আছে। আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শর্করা জাতীয় খাবারের বিভিন্ন ধরন আছে। আমরা চট করে ওদের মতো হতে পারব না; হলেও লাভ কতটুকু হবে, সন্দেহ আছে।
ডায়েট চার্ট আসলে কেমন হওয়া উচিত? এটা এমন অদ্ভুত কিছু নয়, যেটা আপনি চালিয়ে নিতে পারবেন না। আপনার ভুলে গেলে চলবে না, আপনি আপনার শরীরের সঙ্গে যা করবেন শরীর বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবেই। আপনার মনে রাখতে হবে আপনার খাবারের সঙ্গে শরীরের প্রতিটা জিনিস সম্পর্কযুক্ত।
কিছু কিছু ডায়েট চার্ট এমন যেখানে এক দানা ভাতও থাকে না বা কার্বোহাইড্রেটের কোনো সোর্সই থাকে না। এ রকম ডায়েট চার/পাঁচ দিন চলার পরেই শুরু হয় মাথাব্যথা, লো মুড, চোখে ঝাপসা দেখান।
অনেকে আবার অ্যাডভাইস দেয়, ‘ভাত খেয়েই তো এত মোটা হয়েছো, ভাত বাদ দাও একদম।’
ভাত বাদ দিয়ে কী খেয়ে বাঁচবে, তা কেউ বলে না।
আসুন জেনে নিই শরীরের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট কার্বোহাইড্রেট কোন কোন খাবারে পাওয়া যায়।
ভাত, রুটি, ডাল, ওটস, নুডুলস,পাস্তা, সবজি, ফল ও বিস্কুট। কেউ মনে করেন ভাত বাদ দিয়ে ওটস বা রুটি খেলেই ওজন কমবে। কেউ মনে করেন সারা দিন শুধু ফল খেয়ে ওজন কমাবেন।
আসুন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিই এবং বোঝার চেষ্টা করি রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট কী? গ্লাইসেমিক ইনডেক্স জানা জরুরি কেন।
আমরা যখন কোনো শর্করা জাতীয় খাবার খাই, শরীর সেটাকে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত করে। গ্লুকোজের রেসপন্সে শরীরে ইনসুলিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। এই ইনসুলিন গ্লুকোজকে তার গন্তব্যে নিয়ে যায়। শরীরের একটা নির্দিষ্ট চাহিদা থাকে। তার বেশি কার্বোহাইড্রেট খাওয়া হলে অতিরিক্তটুকু সেই ইনসুলিন চর্বিতে রূপান্তরিত করে শরীরে জমিয়ে রাখে।
কার্বোহাইড্রেটের ধরনের ওপর ইনসুলিনের পরিমাণ কম-বেশি হয়। যত বেশি রিফাইন্ড, তত দ্রুত সে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায় ফলশ্রুতিতে তত বেশি ইনসুলিন আসতে থাকে। এ অতিরিক্ত ইনসুলিন শরীরে চর্বি জমিয়ে রাখতে কাজ করে।
সহজে যদি বলি ভাত যদি লাল চালের হয়, তাহলে সর্বোত্তম। রুটিও তেমনি হতে হবে লাল আটার। ওটসও ইন্সট্যান্ট না হয়ে হতে হবে রোলড ওটস।
নুডলস, পাস্তা অতি রিফাইন্ড এবং প্রসেসড। খাওয়া উচিত নয় ময়দার তৈরি পরাটা বা যেকোনো নাশতা। সবজি খেতে হবে পরিমাপমতো। মিষ্টি ফল হলে অবশ্যই মেপে।
লাল চাল বা আটায় ফাইবারের পরিমাণ অনেক বেশি থাকায় এটি ধীরে ধীরে রক্তে শোষিত হয়, ইনসুলিনের মাত্রাও ধীরে ধীরে বাড়ায়। এটা ডায়াবেটিস রোগীদের অবশ্য পালনীয়। যারা ওজন কমাতে চান তাদের জন্যও এ বিষয়টা বোঝা জরুরি।
আমরা বাঙালিরা নিয়মিত ভর্তা, ভাজি, শুটকির মতো মুখরোচক খাবারের আয়োজন করি। প্রতি আইটেমের সঙ্গে ভাত নিতে থাকি। আমরা জানিই না কে কতটুকু ভাত খাই। সমস্যাটা এখানেই।
আপনি যখন একজন দক্ষ ও আন্তরিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন, তখন তিনি আপনার ম্যাক্রো রেশিও অ্যাডজাস্ট করে ভাতের পরিমাণ গ্রামে বলে দেবেন। সেটা আপনি কিচেন স্কেলে মেপে খাবেন।
রুটি খেলে কতটুকু আটার খাবেন মেপে নেবেন। তেমনি রোলড ওটস ও মেপে খেতে হবে। আর ময়দার তৈরি খাবার, মিষ্টি জাতীয় খাবার, নুডলস, পাস্তা, বিস্কুট এড়িয়ে চলবেন যদি সত্যিই ওজন কমাতে চান।
ছোট কয়েকটা টিপস
আপনার পরিমাপমতো ভাত নিয়ে তার সঙ্গে সব আইটেম একবারে নিয়ে নেবেন। তাহলে একবারে অনেক খাবার চোখ দেখবে এবং মস্তিষ্কে সংকেত যাবে যে, আপনি প্রচুর খাবার খাচ্ছেন এবং আপনার স্যাটাইটি সেন্টার দ্রুত পরিতৃপ্তি লাভ করবে।
তরকারির ঝোল বাদ দিয়ে খেলে আপনি অপ্রয়োজনীয় তেল ও লবণ খাওয়া থেকে বেঁচে যাবেন।
রোজার সময় না খেয়ে থাকেন যত লম্বা দিনের রোজাই হোক, মনকে সেভাবে শক্ত করে ডায়েট শুরু করুন। ইনশাল্লাহ মোটিভেশন হারাবেন না। নিয়মিত এক্সারসাইজ ডায়েটের মোটিভেশন ধরে রাখতে সাহায্য করে।
ডায়েটের ভূমিকা ৮০ ভাগ, এক্সারসাইজের ২০ ভাগ। ওজন কমাতে এটা একটা প্রচলিত অতি সত্যি কথা, তবে ওই ২০ ভাগের অন্য কোনো বিকল্প নেই।
শুরুতে যে আধুনিকার গল্প বললাম, তিনি সারা দিনে ভাত কমিয়ে দিয়ে খেয়েছিলেন নানা ধরনের রিফাইন্ড কার্ব, সাদা চিনি এবং তেলে ভাজা বিভিন্ন নাশতা। পাশাপাশি চিকিৎসক থেকে পালিয়ে বেরিয়েছেন। শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি হারিয়েছে, হারিয়েছে মাথার চুল ও ত্বকের মসৃণতা।
না জেনে, কম খেয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা করা নানা দিক থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। আসুন সচেতন হই।