রাজধানীর বনশ্রী এলাকার পঞ্চাশোর্ধ্ব কিসমত আরা করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নিতে নিবন্ধন করেন গত ১০ জুলাই। যাতায়াতের সুবিধার জন্য তিনি কেন্দ্র নির্বাচন করেন মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।
নিবন্ধনের তিন সপ্তাহ পার হলেও টিকার তারিখ জানিয়ে তার কাছে কোনো এসএমএস আসেনি। এতদিনেও টিকা না নিতে পেরে হতাশ তিনি। এর মধ্যে করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
নিবন্ধন করে টিকার তারিখ না পেয়ে হতাশায় গাজী সালাউদ্দিন মামুনও।
তিনি বলেন, ‘টিকা পেতে ১৪ জুলাই রেজিস্ট্রেশন করেছি। কিন্তু এখনও মেসেজ পাইনি। টিকার সরবরাহই যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে খামোখা বয়স কমাচ্ছে কেন?
‘এর চেয়ে কি বয়স্ক ও অধিকতর ঝুঁকিতে যারা আছেন, তাদের দ্রুত টিকা নিশ্চিত করাটা জরুরি নয়?’
তিনি অভিযোগ করেন, টিকাকেন্দ্রে যাদের পরিচিত লোক আছে, তারা আগে সিরিয়াল পাচ্ছেন। এ কারণেই দেখা যাচ্ছে, কম বয়স্করাও টিকা পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ বয়স্ক ও অধিক ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা টিকা পাচ্ছেন না।’
টিকা নিতে নিবন্ধন করেছেন মুজাহিদ ইসলাম সাব্বির।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পাঁচ সদস্যের পরিবারের সবাই টিকার জন্য নিবন্ধন করেছি। টিকাকেন্দ্র মিরপুর-১৪-এর ডেন্টাল কলেজ। নিবন্ধন করা হয় ৬ জুলাই। এখনও এসএমএস আসেনি। কেন্দ্রে যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।’
এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পছন্দসই কেন্দ্রে নিবন্ধন করে কেউ টিকা নেয়ার জন্য খুদেবার্তা পাচ্ছেন খুবই কম সময়ে। আবার তিন সপ্তাহ হয়ে গেলেও এসএমএস আসছে না অনেকের।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে গণটিকাদান শুরু হয়। টিকা সংকটের কারণে কিছুদিন টিকাদানে ধীরগতি থাকলেও গত ৩০ জুন নিবন্ধন কার্যক্রম দ্বিতীয় দফায় উন্মুক্ত করে সরকার। একই সঙ্গে টিকা নিবন্ধনের বয়সসীমা কমানো হয়।
নিবন্ধনকৃত কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে নাগরিকদের খুদেবার্তা পাঠায়। এর মধ্যে কোনো কেন্দ্রে বেশি নিবন্ধন হলে তাতে টিকা নেয়ার জন্য খুদেবার্তা আসতে দেরি হয়। আর যে কেন্দ্রে নিবন্ধন কম, তাতে কম সময় লাগে।
রাজধানীসহ সারা দেশে অনেকে নিবন্ধনের পর টিকা গ্রহণের জন্য অপেক্ষমাণ আছেন। ফলে বর্তমানে নিবন্ধনের সংখ্যা বাড়লেও টিকা গ্রহণের হার অনেক কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ২ আগস্ট পর্যন্ত ১ কোটি ৬১ লাখ ৮ হাজার জন টিকাপ্রত্যাশী নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ৫০ শতাংশই নিবন্ধন করেছেন গত এক মাসে। সোমবার ২৪ ঘণ্টায় নিবন্ধন করেছেন ৪ লাখের বেশি মানুষ।
এর বিপরীতে টিকা দেয়া হয়েছে ২ লাখের মতো। এ কারণে দিনে দিনে নিবন্ধন করে টিকাপ্রত্যাশীদের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়তি ২ লাখ মানুষের টিকার ব্যবস্থা কীভাবে হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, অল্প সময়ের মধ্যে এটি সমাধান হবে।
দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের টিকা নেয়ার আগ্রহ তৈরি হলেও দৈনিক সক্ষমতা অনুযায়ী টিকা দিতে পারছে না স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
শিগগরিই বয়সসীমা ১৮তে নামিয়ে আনা হবে বলে পরিকল্পনা করছে সরকার। এতে স্বাভাবিকভাবে নিবন্ধনসংখ্যা বাড়লেও কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার জটিলতার কারণে ভোগান্তি বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সপ্তাহে ১ কোটি টিকা দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে আর এ সমস্যা থাকবে না।
নিবন্ধনের পর তারিখ পেতে দেরি হওয়ার মূল কারণ জানতে চাইলে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক মোহাম্মদ শিহাবউদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে বর্তমানে ৩৫ হাজার নিবন্ধন রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই নতুন করে নিবন্ধন হচ্ছে।
‘আমরা প্রতিদিন টিকা দিচ্ছি ৭০০ থেকে ৮০০ জনকে। এ কারণে টিকা দেয়ার তারিখ জানিয়ে এসএমএস ছাড়তে দেরি হচ্ছে। আমরা যে হারে টিকা দিচ্ছি, তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে নিবন্ধন হচ্ছে। ফলে টিকাপ্রত্যাশীদের সারি দীর্ঘ হচ্ছে।’
টিকার নিবন্ধনের পর অনেকের দু-এক দিনের মধ্যে এসএমএস চলে আসছে কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষ তার সুবিধা অনুযায়ী হাসপাতালে টিকা দিতে যায়, যে কারণে কিছু হাসপাতালে নিবন্ধন বেশি হচ্ছে। আর কিছু হাসপাতালে নিবন্ধন কমে আসছে।’
সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক খলিলুল রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন ৪০০ টিকা দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে। তবে নিবন্ধন হচ্ছে প্রতিদিন ২ হাজারের ওপরে।
‘এ কারণে দ্রুত এসএমএস দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে দেরি হলেও সবাই টিকা পাবেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধনের পার্টটা আমাদের। তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটা আমাদের। তবে এসএমএসের দায়িত্ব সারা দেশের ৬৭৬টি টিকাকেন্দ্রের এবং কেন্দ্রে যারা চিকিৎসক রয়েছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যারা দায়িত্ব রয়েছেন, তাদের।
‘তারা ঠিক করেন এই কেন্দ্রে কত হাজার নিবন্ধন করা হয়েছে এবং কাদের টিকা দেয়ার জন্য এসএমএস দেয়া হবে। সেই অনুযায়ী কেন্দ্র থেকে তালিকা ঠিক করে এসএমএস পাঠানো হয়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএসের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিকা নিবন্ধনের বয়স কমিয়ে আনার পর থেকেই ব্যাপক হারে টিকার নিবন্ধন হচ্ছে। নিবন্ধনের তালিকা অনেক লম্বা হয়ে আসছে।
‘এক কেন্দ্রে দৈনিক ২০০ জনের টিকা দেয়ার সক্ষমতা থাকলেও নিবন্ধন হচ্ছে অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে এসএমএস আসতে একটু দেরি হচ্ছে।’
উদ্বিগ্ন না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মিজানুর বলেন, ‘যারা নিবন্ধন করেছেন, তারা সবাই টিকা পাবেন। টুডে অর টুমরো (আজ বা কাল) এসএমএস আসবে। এতে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।’