বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এটি শিশুদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ না থাকা শিশুদের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ১৭ গুণ বেশি।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল (এমজিএইচ) পরিচালিত এক যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এ গবেষণার বিষয়ে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
ওপেন ফোরাম ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রোগজীবাণুর প্রতিরোধী হয়ে ওঠা একটি সম্ভাব্য মারাত্মক মহামরি তৈরি করতে পারে, যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে পারে।
যৌথ এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, আইসিডিডিআর,বির নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস ডিভিশনের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ড. মোহাম্মদ যোবায়ের চিশতি।
ড.চিশতি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক এবং শ্বাসতন্ত্রের উন্নততর চিকিৎসা সত্ত্বেও ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক ডজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।’
নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের একটি সংক্রমণ, যার ফলে এর বায়ু থলিগুলোতে তরল পদার্থ ও পুঁজ জমা হয়। এতে কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। কার্যকর চিকিৎসা ছাড়া এই সংক্রমণ প্রাণহানিকর হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ নিউমোনিয়া। কমবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ভাইরাসের কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়ার কারণেও নিউমোনিয়া হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উচ্চ আয়ের দেশে স্ট্যাফিলোকক্কাস (স্ট্যাফ), স্ট্রেপটোকক্কাস (স্ট্রেপ) এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, যা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে উপশম হয়। শেষের দুটি জীবাণুর ক্ষেত্রে টিকা বিশ্বব্যাপী অসংখ্য জীবন রক্ষা করেছে।
ড. চিশতি জানান, তিনি এবং তার সহকর্মীরা ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পাঁচ বছরের কমবয়সী চার হাজারের বেশি শিশুর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রেকর্ড পরীক্ষা করেন। তারা দেখেন যে ব্যাকটেরিয়াজনিত একদম ভিন্ন ধরনের সংক্রমণ ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য স্থানে নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী সাধারণ স্ট্যাফ ও স্ট্রেপের কারণে সংঘটিত সংক্রমণের হার এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ছিল।
এসব শিশুর মধ্যে যাদের পজিটিভ কালচার ছিল তাদের মধ্যে গ্রাম নেগেটিভ ব্যকটেরিয়া ৭৭ শতাংশ সংক্রমণের জন্য দায়ী ছিল। এসব জীবাণুর মধ্যে ছিল সিউডোমোনাস, ই. কোলাই এবং ক্লেবসিয়েলা প্রভৃতি।
গবেষণার সহপ্রধান লেখক ও ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটাল ফর চিল্ড্রেনের পেডিয়ট্রিক গ্লোবাল হেলথ বিভাগের প্রধান ড. জেসন হ্যারিস বলেন, ‘গবেষণায় পাওয়া প্রায় ৪০ শতাংশ গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় সচরাচর ব্যবহৃত প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধকে প্রতিরোধ করে। যেসব শিশুর ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ ছিল না তাদের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ১৭ গুণ বেশি ছিল।’
ড. হ্যারিস মনে করেন গবেষণার ফলাফল এই বাস্তবতা তুলে ধরে যে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে, এমন দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ এখন ইতোমধ্যেই শেকড় গেড়ে বসেছে।
ড. হ্যারিস বলেন, ‘এসব শিশু ইতোমধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার কারণে অকালে মারা যাচ্ছে। একই কারণে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ভয়াবহ সংক্রমণের সৃষ্টি হবে।’
আইসিডিডিআরবির এক্সকিউটিভ ডিরেক্টর ও এই গবেষণার জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে যেসব কারণে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে যারা বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না, তারা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনতে পারে। অনেক মানুষ আমাশয়, সর্দি, কাশি ও জ্বরের মতো সাধারণ অসুস্থতায় নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে নিজেদের চিকিৎসা করে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার বৃদ্ধি করে।’
ড. আহমেদ আরও বলেন, ‘দেশে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ শনাক্ত করার মতো ল্যাবও অপ্রতুল। এছাড়া পরিষ্কার পানি ও সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারে বড় কারণ হিসেবে কাজ করে।’
ড. হ্যারিস বলেন, ‘কোভিড-১৯ যদি একটি জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে তবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের সমস্যা বন্যার পানির মতো। বাংলাদেশের শিশুরা ইতোমধ্যেই এতে তলিয়ে যাচ্ছে।’
আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, বাংলাদেশ, কানাডা, সুইডেন এবং যুক্তরাজ্য সরকারের অর্থায়নের সাহায্যে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়।