করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা এবং জনসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার এক হাজার ২৫১ জন চিকিৎসককে বদলির যে আদেশ দিয়েছে, সেটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বা বিএমএ। তাদের দাবি, যে আদেশ জারি করা হয়েছে, সেটি ‘বিতর্কিত ও ভ্রান্ত’।
আদেশ বাতিলের দাবিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কাছে একটি চিঠিও দিয়েছে বিএমএ। এতে দ্রুত সময়েরর মধ্যে এই আদেশ বাতিল করা না হলে যে কোনো কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা।
সংগঠনটির সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক ইহতেশামুল হক চৌধুরীর সই করা সেই চিঠিতে বলা হয়, ‘বিএমএ অনতিবিলম্বে এই বিতর্কিত আদেশ বাতিল করার জোর দাবি জানাচ্ছে এবং ভ্রান্ত আদেশ জারিতে জড়িত রাষ্ট্র, জনগণ ও সরকারের স্বার্থ বিরোধী কর্মকর্তাদের বিচারের দাবি করছে।’
গত রবি ও সোমবার মোট ৪৬টি প্রজ্ঞাপনে এক হাজার ২৫১ চিকিৎসকের এই বদলির সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
উপসচিব সারমিন সুলতানা ও জাকিয়া পারভীনের সই করা এসব আদেশে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা এবং জনসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নতুন কর্মস্থলে করোনা চিকিৎসায় কাজ করবেন বদলি করা চিকিৎসকরা।
তবে বিএমএর চিঠিতে বলা হয়, ‘যেসব চিকিৎসক দীর্ঘদিন রোগী দেখেন না, বিশেষ করে বেসিক সাবজেষ্ট ও রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক, তাদেরকেও করোনা রোগী দেখার জন্য বদলি করা হয়েছে। এমনকি দন্ত চিকিৎসক, নিউরো সার্জনসহ অন্যান্য বিশেষায়িত বিভাগের বিশেষজ্ঞগণকে বদলি করা হয়েছে, যারা করোনা রোগী দেখায় কীভাবে ভূমিকা রাখবে তা আমাদের বোধগম্য নয়।’
মাইক্রোবায়োলজি কিংবা করোনা ল্যাবে কর্মরত চিকিৎসকদেরকেও বদলি করে দেয়ায় আরটিপিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা কার্যক্রম মারাত্মভাবে ব্যহত হবে বলেও মত দিয়েছে বিএমএ।
ওই আদেশে মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকদেরকেও বদলি করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে বিএমএ। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন চিকিৎসক নিয়োগ বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এই কাজের জন্য আমলাতন্ত্রকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। তাদের দাবি, মহামারি নিয়ন্ত্রণ একটি সমন্বিত কার্যক্রম। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের পরামর্শের বিকল্প নেই।
চিঠিতে বলা হয়, ‘সেখানে শুধু আমলাতন্ত্র এতটা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে যে, তারা যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভ্যন্তরে যে উপনিবেশিক আমলাতন্ত্র বিরাজ করছে তারই প্রতিফলন ভিন্ন ক্যাডার দিয়ে দিকভ্রান্তের মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা।’
আদেশকে ‘হাস্যকর ও অসাড়’ উল্লেখ করে বিএমএ বলছে, ‘চিকিৎসকদের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি করা ও সরকারকে বিভ্রান্ত করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা একটি অসাধু চক্র নিরন্তর অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এই আদেশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসকদের সুকৌশলে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চায়।’
আদেশে বিস্মিত আওয়ামী লীগের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ১২ জুন থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রী থাকা শেখ ফজলুল করিম সেলিমও এই আদেশে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
সেলিম বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এভাবে ডাক্তার বদলির কিছু শুনি নাই। আমিও তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলাম। এ রকম আমরা কখনও বদলি করিনি। আমরা যে বদলি করতাম তার একটা গাইডলাইন ছিল। একটা লোক যদি এক স্থানে তিন বছর থাকে, তাকে সেখান থেকে বদলি করা যেতে পারে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা যে কেন করল, কিসের জন্য করল জানি না। এটা একটা মারাত্মক ভুল হইছে। ডাক্তারদের ভেতর একটা মারাত্মক ক্ষোভ সৃষ্টি হইছে এখন।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যে ব্যাখ্যা
বদলির আদেশ নিয়ে অবশ্য অন্য ব্যাখ্যা দিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘করোনা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে আমাদের অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন হচ্ছে। আমার নতুন চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছি, শুধুমাত্র করোনা চিকিৎসা দেয়ার জন্য।’
কিন্তু তাতেও চাহিদার সংকুলান না হওয়ায় এই বদলির সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ‘কিছু চিকিৎসক আছেন যারা মেডিক্যাল কলেজে কাজ করেন এবং অন্য সেবা দেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হিসেব করে দেখলেন তাদের করোনা চিকিৎসা কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। এমন পরিকল্পনা থেকে এই আদেশটা দেয়া হয়েছে।’
বদলির সিদ্ধান্তরে সমালোচনা প্রসঙ্গে জাহিদ মালেক বলেন, ‘চলতি কাজের সঙ্গে নতুন কাজটি সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এটা স্বল্প সময়ের জন্য, এটা বদলিও না। তবে এই কাজটি তাড়াতাড়ি করে করতে গিয়ে ক্রটি দেয়া দিয়েছে। এটাকে আবার ঠিক করে দেয়া হচ্ছে।’