বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৭০ টাকার ইনজেকশন, চিকিৎসক নিলেন হাজার

  •    
  • ১ জুলাই, ২০২১ ১৫:২১

অ্যালার্জির সমস্যায় ভুগছিলেন কিশোরগঞ্জের পলাশ সরকার। সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গেলে চর্মরোগ বিভাগের প্রধান তার ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ লোক দিয়ে তাকে ব্যক্তিগত চেম্বারে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে ৭০ টাকার ইনকেজশন পুশ করে তার কাছ থেকে আদায় করা হয় ২০ গুণ টাকা।

কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ৭০ টাকার ইনজেকশনের বিনিময়ে ১৫ গুণ বেশি টাকা আদায়ের অভিযোগ করেছেন এক রোগী।

মেডিক্যাল কলেজের চর্ম, যৌন ও অ্যালার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ একরাম আহসান জুয়েলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন তার কাছে চিকিৎসা নেয়া পলাশ সরকার। তিনি জানান, ওই চিকিৎসক তার কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা নেয়ার পর তিনি ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন ইনকেজশনটির দাম ৭০ টাকা।

পরে নিউজবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে সেই চিকিৎসক দাবি করেন, তিনি একটি প্যাকেজের অংশ হিসেবে এই টাকা নিয়েছেন। ইনজেকশন পুশ করা, গ্লাভসের খরচ ও ভিজিট ধরেছেন। তবে ভিজিট ৫০০ ধরলেও ইনজেকশনের দাম হয় এক হাজার টাকা।

এ বিষয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও অভিযোগ দিয়ে এসেছেন ভুক্তভোগী পলাশ। তবে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

আহসান জুয়েল ওই মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান। তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে চেম্বার দিয়েছেন অন্য একটি হাসপাতালে।

ওই হাসপাতাল পপুলার মাল্টিকেয়ারে সরকারি হাসপাতালের রোগী পাঠিয়ে কারণে-অকারণে পরীক্ষা করানোর অভিযোগও আছে।

সদর উপজেলার দানাপাটুলী এলাকার বাসিন্দা পলাশ সরকার শরীরে অ্যালার্জিজনিত সমস্যা নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। বহির্বিভাগ থেকে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চর্মরোগ বিভাগের প্রধান আহসান জুয়েলের সঙ্গে দেখা করেন তিনি।

পলাশকে কিছু ওষুধ ও কয়েকটি টেস্ট করিয়ে পরে আবার সাক্ষাৎ করতে বলেন জুয়েল। চেম্বার থেকে বের হয়ে খানিকটা এগোতেই আসেন এক ব্যক্তি। তিনি সেই চিকিৎসকের ব্যক্তিগত লোক পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘জুয়েল স্যারকে দেখাইছেন?’

‘জি’ বলার পর ওই লোক বলেন, ‘স্যার আমাকে পাঠাইছেন, আমি স্যারের লোক। স্যার বলছেন এই টেস্টগুলো পপুলার থেকে করিয়ে স্যারকে দেখানোর জন্য।’

সমস্যার জন্য হাসপাতালে না এসে ‘স্যারের নিজস্ব চেম্বারে গেলে’ গুরুত্ব বেশি পাওয়া যাবে বলেও জানান তিনি।

তার কথা শুনে ওই দিন বিকেলেই পলাশ চলে যান শহরের শোলাকিয়া এলাকায় পপুলার মাল্টিকেয়ার হাসপাতালে।

সেখানে গেলে মোট তিনটি টেস্টের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানালেন একটা ভালো ইনজেকশন দিলেই আপনার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।

একরাম আহসান সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের চর্ম, যৌন ও অ্যালার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ

পলাশ জানান, চিকিৎসক জুয়েল তাকে বলেন, ‘এই ইনজেকশনের জন্য আপনাকে অন্য কোথাও যেতে হবে না, সেটাও রয়েছে আমাদের কাছেই। তবে টাকা লাগবে ১৫০০।’

দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হবে ভেবে রাজি হন পলাশ। আর চিকিৎসক নিজে গিয়ে পপুলার মাল্টিকেয়ার হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে নিয়ে আসেন ইনজেকশনটি। পুশ করেন পলাশের পায়ে।

পরে ট্রিয়ালন নামের ইনজেকশনটি সম্পর্কে কৌতূহল জাগে পলাশের। স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে গিয়ে দাম জানতে চাইলে জানতে পারেন এটার দাম ৭০ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন চিকিৎসকের ভিজিটিং কার্ডে দেয়া নম্বরে।

বারবার ফোন করেও কোনো সাড়া না পেয়ে আসেন চেম্বারে। সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসক একরাম আহসান জুয়েল ইনজেকশনের এত দাম নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি পুরো প্যাকেজ হিসেবে ১৫০০ টাকা নিয়েছি। সেখানে আমার ভিজিট, গ্লাভসসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র রয়েছে।’

ভিজিট কত- এমন প্রশ্নে চিকিৎসক জুয়েল বলেন, ‘৫০০ টাকা।’

ভিজিট নিলে আবার ইনজেকশন পুশের খরচ কেন নেয়া হবে। আর একটি গ্লাভসের দাম ৫ থেকে ৭ টাকা, সেটির জন্য এত টাকা নেয়ার কী যুক্তি, এসব বিষয়ে প্রশ্নে নীরব থাকেন ওই চিকিৎসক।

রোগী পলাশ বলেন, ‘আমি কেন তাকে ভিজিট দেব? হাসপাতালে যাওয়ার পর তিনিই তো এখানে আসতে বলেছেন। আমি তো ভেবেছি, বাড়তি টাকা লাগবে না। আচ্ছা, তাও মানলাম। তাহলে ৭০ টাকার ইনজেকশনের দাম তাও তো এক হাজার টাকা হয়।

আরও যত অভিযোগ

পলাশ বিষয়টি ফেসবুকে প্রকাশ করার পর তার পোস্টের নিচে আরও অনেকেই একইভাবে ঠকার বিষয়টি প্রকাশ করেন।

কর্শাকড়িয়াল এলাকার বাসিন্দা হোসাইন মোহাম্মদ দেলোয়ার বলেন, ‘আমি নিজেও ওনার কাছে চর্মরোগের সমস্যায় গিয়েছিলাম। পরে অনেক টেস্ট শেষে রিপোর্ট দেখে একটি সাবান এবং একটি শ্যাম্পু দিয়েছিলেন। সেগুলোর দাম রেখেছিলেন ৪৫০ এবং ৫০০ টাকা। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সেগুলোর মূল্য ৯০ থেকে ১২০ টাকা। ফলাফল শূন্য।’

এই হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন একরাম আহসান

জিয়াউদ্দীন খান নামে একজন তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম চর্মরোগের চিকিৎসার জন্য। সেখানে যাওয়ার পরে আমার স্ত্রীকে দেখে কিছু ওষুধ দিল, টেস্ট দিল। তারপর একটা কাগজে কিছু লিখে পাঠিয়ে দিল আরেক ডাক্তার, তার স্ত্রীর কাছে। তার স্ত্রীও একই হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ। তিনিও কিছু টেস্ট দিয়ে বললেন, মহিলাদের অনেক সমস্যা থাকে। এই টেস্টগুলো করিয়ে নেন। ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে।’

দুজন মিলে ২ হাজার ৭০০ টাকা বিল করেন।

এরপর জিয়াউদ্দীনকে ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনাদের টিটেনাস দেয়া আছে?’

‘ঠিক মনে নাই’- এই জবাব দেয়ার পর আরও দুটি পরীক্ষা যোগ হলো। বিল বাড়ল ৮০০ টাকা। এরপর তাদের এইচআইভির পরীক্ষা করিয়ে বিলে আরও যোগ হয় ৮০০ টাকা।

জিয়াউদ্দীন বলেন, ‘এরপর দ্বিতীয়বার এই ডাকাতের কাছে আর যাইনি। তিনি তাবলিগও করেন, ধার্মিকও বটে। কিন্তু লোভী। এর একটা ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।’

মায়ের অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় এমদাদুল হক শরীফ নামে একজন এসেছিলেন এই ডাক্তারের কাছে। তিনিও ঠকেছেন। বলেন, ‘আম্মাকে দেখে CBC, Serum creatine, anti alegric, HBSAg, X ray এই টেস্টগুলো দিয়েছিল। যদিও অ্যালার্জির জন্য অ্যান্টি অ্যালার্জি টেস্টটা করালেই চলত। তারপরেও এই টেস্টগুলো না করে কোনো উপায় ছিল না।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসক জুয়েল বলেন, ‘মানুষ তো একটা সুযোগ পেলেই সত্যতা যাচাই না করেই আজেবাজে মন্তব্য করে থাকে। এগুলো তারা না বুঝে করতেছে।’

একপর্যায়ে তার সঙ্গে দেখা করে বক্তব্য নেয়ার প্রস্তাব দিলে এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আমি অসুস্থ। আমার করোনা পজিটিভ। গত শনিবারের আগের শনিবার থেকে আমি বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছি।’

তবে তার এই দাবির সত্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কারণ, তিনি যে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করান, সেটির কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা মনিরুজ্জামান রকি জানান, দুই দিন আগেও সেই জুয়েল রোগী দেখেছেন।

তিনি করোনা আক্রান্ত কি না- জানতে চাইলে তিনি হেসে বলেন, ‘এই কথা আপনাকে কে বলছে?’

যা বলছে চিকিৎসা প্রশাসন

চিকিৎসক জুয়েলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) অনুপম ভট্টাচার্য বলেন, ‘পলাশ সরকার নামে এক ব্যক্তি আমার কাছে এসেছিলেন। মৌখিকভাবে তিনি আমার কাছে অভিযোগ করে গিয়েছেন । আমি তার মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি।’

জুয়েলের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনি তো অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এবং উনি মেডিক্যাল কলেজের অধীনে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং উপপরিচালক কেউই নেই। নতুন পদায়ন হয়েছে। ওনারা আগামী রোববারে যোগদান করবেন। তখন এই বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করব।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন মুজিবুর রহমান জানান, তিনি ভুক্তভোগী পলাশ সরকারের অভিযোগ ফেসবুকে দেখেছেন এবং পোস্টের লিংকটি চিকিৎসক জুয়েলকে মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছেন।

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উনি যদি হাসপাতালে রোগী দেখেন, সেই বিষয়টা হাসপাতালেই রাখবেন। কিন্তু হাসপাতালে কেউ আসলে তাকে প্রাইভেট চেম্বারে পাঠিয়ে থাকলে সেটা তিনি ঠিক করেননি।’

এ বিভাগের আরো খবর