বন্ধ থাকার প্রায় তিন মাস পর খুলে দেয়া হলো কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলগুলো। এতে কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন এই খাতসংশ্লিষ্টরা। তবে তারা বলছেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া না হলে এই সিদ্ধান্তের সুফল ঘরে উঠবে না।
কক্সবাজার দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। সুযোগ পেলেই স্বস্তির খোঁজে এখানে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মানুষ। যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি ভুলতে তারা নেমে পড়েন সমুদ্রসৈকতে। সাগরের নোনা জলে পা ভিজিয়ে আনন্দঘন সময় কাটে অনেকের। এই আনন্দের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় আশপাশে ছড়িয়ে থাকা ঝাউবনসহ ঘন সবুজ প্রকৃতি।
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে সংক্রমণ ঠেকাতে চলতি বছরের ৫ এপ্রিল বন্ধ করে দেয়া হয় কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউসগুলো। সেই সঙ্গে সব পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণে আসে নিষেধাজ্ঞা। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টরা।
কলাতলী লাইট হাউস পাড়ার বাসিন্দা জয়নাল। কয়েক বছর ধরে সৈকত লাগোয়া একটি চায়ের দোকান চালান তিনি। কিন্তু গত আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ তার আয়ের একমাত্র উৎস।
দীর্ঘদিন পর্যটক না আসায় অর্থকষ্টে পড়ে এখন রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন তিনি।
জয়নাল বলেন, ‘হোটেল খুলে দেবে শুনে খুশি হয়েছিলাম। তবে সমুদ্রসৈকতে পর্যটক নামতে পারবেন না জেনে খারাপ লাগছে। আমি চাই সৈকতে নামার নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হোক।’
পর্যটকবাহী ট্যুরিস্ট জিপ মালিক আবদুস সাত্তার বলেন, ‘পর্যটক না থাকায় জিপগাড়িগুলো বেকার পড়ে আছে। ফলে আমাদের পরিবার চরম অর্থসংকটে পড়েছে। কারণ আমাদের আর কোনো আয় নেই। এখন কোথায় নতুন করে কাজ শুরু করব, সেটাও বুঝতে পারছি না। এ অবস্থায় দ্রুত পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় হোটেলের আসবাব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে দেখা গেছে কর্মচারীদের। অনেক কর্মচারীকে বিনা বেতনে ছুটি দিলেও আবার তাদের ডেকে আনা হয়েছে।
হোটেল পিংকশোরের ফ্ল্যাট ব্যবসায়ী রায়হান সিদ্দিকী বলেন, ‘মানুষ বেড়াতে আসে সমুদ্রসৈকত দেখার জন্য, একটু পরিবারকে নিয়ে নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য, এখানে হোটেল খুলে দিলেও পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ থাকায় কোনো রুম ভাড়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবু আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, কারণ আশা করছি যেকোনো সময় পর্যটনকেন্দ্রও খুলে দেবে সরকার।’
পর্যটকশূন্য সুমদ্রসৌকত
হোটেল-মোটেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিকে সঙ্গী করেই জীবন যাপন করতে হবে, এই কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন। করোনাভাইরাস যেহেতু একেবারে দেশ থেকে বিদায় নেবে না, তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে।
‘কক্সবাজারের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন, দ্বিতীয় মৎস্যশিল্প। বর্তমানে দুটিই বন্ধ; তাহলে স্থানীয় মানুষ কী নিয়ে বাঁচবে। কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে? সেটা সরকারকে ঠিক করে দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে অনেক দেশ লকডাউন তুলে দিয়ে বিনোদন কেন্দ্রগুলো চালু করেছে। কারণ মানুষের মানসিক মনোবল শক্ত রাখার একমাত্র মাধ্যম বিনোদন। তাই আমরা মনে করি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কক্সবাজারের পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেয়া দরকার।’
পর্যটন উদ্যোক্তা মুফিজুর রহমান বলেন, ‘পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ রেখে হোটেল খুলে দেয়ার কোনো মানে হয় না। এখানে মানুষ বেড়াতে এসে হোটেলে ঘুমাবে না। আমার মতে, প্রশাসন আন্তরিক হলে কক্সবাজারে কিছু পর্যটন স্পটকে বাছাই করে সেগুলো খুলে দিতে পারে।
‘প্রয়োজনে সেখানে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। এতে আমরাও সহযোগিতা করব। পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করবে। তবে আমি একেবারে হতাশ নই। কারণ আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক করার জন্য চেষ্টা করছে সরকার।’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২৪ জুন থেকে পরীক্ষামূলক সাত দিনের জন্য হোটেল-মোটেল খোলার জন্য নির্দেশনা দেয়া হলেও সেখানে বেশ কিছু শর্ত থাকবে।
সেগুলো হলো, হোটেলে ৫০ শতাংশ রুম ভাড়া দেয়া যাবে। হোটেলের রেস্টুরেন্ট খোলা যাবে না।
সুইমিংপুল খোলা যাবে না, বড় কোনো আয়োজন করা যাবে না।
হোটেলের গেটে সার্বক্ষণিক সুরক্ষাসামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু নির্দেশনা চূড়ান্ত হচ্ছে।
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘সরকার কখনও চাইবে না দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকুক। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের স্বার্থ দেখা। পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের কারণে কীভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তা আমরা দেখেছি। তাই আগে জীবনের নিরাপত্তা, তার পর অন্য কিছু। সে জন্য সরকার লকডাউন দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য কাজ করছে। আর হোটেল খোলার বিষয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটাও ভালো। আমরা সরকারের যে নির্দেশনা আসে, সেটা বাস্তবায়নের জন্য সব সময় প্রস্তুত আছি।’