জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আসিফুল হক আসিফ ও চয়ন দেওয়ান। করোনাভাইরাসের প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের টিউশনিতেও ভাটা পড়ে। এমন বাস্তবতায় একটি বিকল্প বের করেন তারা; খোলেন ব্যতিক্রমধর্মী রেস্তোরাঁ।
‘মটকা আঁচ’ নামের সেই রেস্তোরাঁ ময়মনসিংহ শহরের র্যাব সদর দপ্তরের উল্টো পাশে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে রেস্তোরাঁটি।
অল্প পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করেছিলেন দুইজন। এখন সাতজন শ্রমিক কাজ করছেন এতে।
রেস্তোরাঁটি এরই মধ্যে ময়মনসিংহে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। শিক্ষার্থীরা এটি পরিচালনা করায় অল্প বয়সীরা আকৃষ্ট হয়েছেন। এ ছাড়া চাসহ বিভিন্ন খাবারের পরিবেশনায় ভিন্নতার কারণে সব বয়সীরাই এখানে আসছেন।
এখানে মাটির হাঁড়িতে চা পরিবেশন অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
উদ্যোক্তা দুজন চারুকলার শিক্ষার্থী হওয়ায় এর ইন্টেরিয়রেও শিল্পের ছাপ। ভেতরে ডেকোরেশনে কাঠ, ফোক আর্ট ও পত্রিকার কাগজ দিয়ে সাজানো।
বাইরের দেয়ালে নব্বই দশকের জনপ্রিয় টিভি চরিত্র বাকের ভাইয়ের দেয়ালচিত্র। এ ছাড়া সুবিধাবঞ্চিত ও গ্রামীণ নারীদের জীবন তুলে ধরা হয়েছে।
রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা যায়, উদ্যোক্তা শিক্ষার্থীরা নানা বয়সী ক্রেতাদের বিভিন্ন ধরনের খাবার পরিবেশন করছেন। বেশির ভাগ ব্যক্তিই মটকা চা পান করছেন।
কেউ কেউ চায়ের চুমুকের ফাঁকে খোশগল্পে সময় কাটাচ্ছেন। অনেকে বাইরের বেঞ্চে বসে চায়ের আড্ডা জমিয়েছেন।
চা পানের ফাঁকে আসাদ, মুস্তাকিম নামে দুজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, দুই বন্ধু মাঝেমধ্যে সময় পেলে এখানে চা পান করতে আসেন। বিভিন্ন ধরনের খাবার থাকলেও এখানকার মটকা চা তাদের বেশি পছন্দ। এর স্বাদও আলাদা। ভেতরের প্রাকৃতিক পরিবেশ তাদের ভালো লাগে।
করোনায় হাল না ছাড়া শিক্ষার্থীদের এই রেস্তোরাঁর কর্মী আজিজুল হক রমজান, শরীফ আহমেদ ও বিল্লাল হোসেন জানান, রেস্তোরাঁয় ওয়েটারদের পাশাপাশি উদ্যোক্তারাও খাবার পরিবেশন করেন। ভালো ব্যবহারের কারণে তৃপ্তি নিয়ে কাজ করেন তারা।
আবিদ হাসান সাকিব নামে চারুকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্র বলেন, ‘আসিফুল হক আসিফ ও চয়ন দেওয়ান দুই বন্ধু টিউশনি করে পড়াশোনার খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ জোগাত। করোনার প্রকোপে টিউশনি না থাকায় দুজন এই রেস্তোরাঁ দিয়েছে। বন্ধুদের এমন সাফল্য দেখে আমাদেরও ভালো লাগে।’
উদ্যোগ শুরুর প্রেক্ষাপট
মটকা আঁচের উদ্যোক্তা আসিফুল হক আসিফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিউশনি হচ্ছে অস্থায়ী কাজ। যা কিছু টাকা পেতাম তা দিয়ে কোনো রকম নিজের খরচ জুগিয়েছি। তবে মনে মনে সব সময় চিন্তা করেছি, ভালো একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে পারলে আর হতাশায় ভুগতে হবে না।
‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই একজন সফল উদ্যোক্তা আফজাল হোসেন শান্ত ভাইয়ের পরামর্শ নিয়ে রেস্টুরেন্ট দিতে অনুপ্রাণিত হই। আমরা দুই বন্ধু মিলে ময়মনসিংহে এই রেস্টুরেন্ট দিয়েছি। এখন আমরা নিজেরা সচ্ছল হওয়ার পাশাপাশি তিনজনকে নিয়মিত ও আরও চারজনকে অস্থায়ী হিসেবে এখানে চাকরি দিয়েছি।’
আসিফ জানান, তার রেস্তোরাঁয় শুধু চায়েরই আছে নানান আইটেম। এগুলো হলো মটকা স্পেশাল চা, মটকা কুলফি, মটকা ফালুদা, রেগুলার চা, তন্দুরি চা ও স্পেশাল তন্দুরি চা। এর বাইরে আছে চিকেন মোমো, হাঁসের মাংস, খাসির নলি ও কলিজা ভুনা। সবগুলোই হাঁড়ি-পাতিলে পরিবেশন করা হয়।
মটকা আঁচের আরেক উদ্যোক্তা চয়ন দেওয়ান বলেন, ‘অন্যান্য খাবারের চেয়ে মটকা চা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। কারণ হচ্ছে গরুর খাঁটি দুধ, দুধের মালাই, সর্বোচ্চ ভালো মানের চা পাতি, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, পাস্তাবাদাম, কিশমিশসহ আরও বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্যসম্মত ড্রাইফুড দিয়ে চা পরিবেশন করা হয়।
‘চা বানানোর মাটির পাত্রটি ৩ হাজারের বেশি তাপমাত্রায় পুড়িয়ে নিই৷ ফলে এতে কোনো ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস থাকে না।’
চয়ন জানান, এ রেস্তোরাঁয় সবকিছু মাটির পাত্রে পরিবেশন করা হয়। ফলে প্রচুর মাটির পাত্রের প্রয়োজন হয়। দুটি কুমারের বাড়ি মাটির পাত্রের জোগান দেয়। মাটির হাঁড়ি বানিয়ে সুদিন ফিরেছে উজ্জ্বল কুমার পাল ও সুলভ কুমার পালের।
আরও শাখা খোলার চিন্তা
প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে রেস্তোরাঁ। তবে সন্ধ্যার পর থেকে লোকজন বেশি আসতে শুরু করে।
উদ্যোক্তারা জানান, জনপ্রিয়তার কারণে আরও আউটলেট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। এর মধ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চত্বরে একটির নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলে এর উদ্বোধন হবে।
শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রধান ড. এমদাদুর রাসেদ সুখন।
নিউজবাংলাকে সুখন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছেন, চাকরি না হলেও হতাশ হওয়া যাবে না; উদ্যোক্তা হতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজের প্রয়োজনে উদ্যোক্তা হয়েছেন।
‘ছোট পরিসরে ব্যবসা করে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কয়েকজন কর্মহীনেরও তারা কর্মের ব্যবস্থা করেছেন। এটির জন্য নিঃসন্দেহে তারা প্রশংসার দাবিদার। কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।’