বরেন্দ্র অঞ্চলে একসময় মাটির ঘরের ব্যাপক চল থাকলেও কালের বিবর্তনে বদলে গেছে চিত্র। তবে এখনও অনেক গ্রামেই দেখা মেলে মাটির ঘর। সেগুলোর মধ্যে বিশেষত্ব খুব একটা নেই, যা আছে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার নিমাইদীঘি গ্রামের একটি ঘরে।
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে থালতা মাজগ্রাম ইউনিয়নের নিমাইদীঘি গ্রাম। আর সেখানেই রয়েছে মাটি দিয়ে তৈরি তিন তলা একটি বাড়ি।
প্রায় ৩৯ বছর আগে ১২ শতক জমির ওপর নির্মিত এই বাড়িটি বেশ শক্তি নিয়েই টিকে আছে। এটি দেখতে আসেন দূরদূরান্তের অনেকেই।
নিমাইদীঘি মধ্যপাড়ায় আরও মাটির বাড়ি রয়েছে, তবে তিন তলা বাড়ি একটিই। শখের বসে এটি নির্মাণ করেছিলেন কৃষক আব্দুর রশিদ মণ্ডল।
১৯৮২ সালে নির্মিত এ বাড়ি শুরুতে দ্বিতল ছিল। তবে আব্দুর রশিদ সে বছরের শেষের দিকেই তিন তলা করেন। ছাউনি দেয়া হয় টালি দিয়ে। সেই টালির কিছুটা এখনও টিকে আছে। রশিদ মারা যাওয়ার পর তার একমাত্র সন্তান ইদ্রিস মণ্ডল কিছু অংশে দিয়েছেন টিনের ছাউনি।
রশিদের ভগ্নিপতি আব্দুল হাকিম জানান, বাড়িটিকে তিন তলা রূপ দিতে আব্দুর রশিদ স্বজনদের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবে তিনি কারও কথা শোনেননি।
কয়েক বছর আগে মারা গেছেন আব্দুর রশিদ, তার স্ত্রীও বেঁচে নেই। শৌখিন রশিদের বিঘা দশেক জমি ছিল, সেগুলো তিনি মৃত্যুর আগে বিক্রি করে দেন। এখন তার একমাত্র সন্তান ইদ্রিস শ্রমিকের কাজ করেন।
ইদ্রিসের স্ত্রী মোছাম্মৎ জেসমিন আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২৫ বছর আগে আমার বিয়ে হয়, এরপর থেকে এখানে বসবাস। মাটির ঘরে থাকার শান্তি আলাদা। গরমের দিনে এসির মতো লাগে, আর শীতের দিনে ঘর গরম থাকে।’
স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি জানান, মাটির ঘর তৈরি করতে মাটি, খড় ও পানি ভিজিয়ে বিশেষ কায়দায় কাদা তৈরি করা হয়। এই কাদা দিয়ে আস্তে আস্তে দেয়াল বানানো হয়। একটি এক তলা ঘর নির্মাণে এক মাস সময় লাগে। কারণ, একবার গাঁথুনি দেয়ার পর ওই মাটি শুকালে আবার দেয়াল উঁচু করতে হয়।
তারা জানান, এ বাড়ির দেয়াল ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া, তবে ভিত আরও চওড়া। তিন তলা এই বাড়ি প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। তবে তিন তলা করায় প্রতিটি তলার উচ্চতা স্বাভাবিক ঘরের চেয়ে কম করা হয়েছে। বাড়ির পুরো কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় ছয় মাস। দোতলা বা তিন তলায় উঠতে বাড়িতে কোনো সিঁড়ি নেই, উঠতে হয় মই দিয়ে।
গ্রামের ৪৯ বছর বয়সী কমর উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আব্দুর রশিদ খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। শখ করে শুধু বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন এমন নয়; বাজারে গিয়ে তার চেয়ে বড় মাছও কেউ কিনতে পারতেন না। আয়ের চেয়ে খরচ বেশি হওয়ায় পরে তিনি এই বাড়িটি ছাড়া সব জমি বিক্রি করে দেন।’
এই মাটির ঘরে এখন ইদ্রিস আলী মণ্ডল, তার স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে আছেন। কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন হলেই কেবল দোতলার দুটি কক্ষ ব্যবহার করা হয়। তিন তলা করা হয়েছিল শুধু ধান রাখার জন্য।
আব্দুর রশিদের চাচাতো ভাই আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমার ভাই শখ করে এই বাড়ি বানিয়েছিল। তখন আমরা বলেছিলাম তিন তলা মাটির বাড়ি ভেঙে পড়তে পারে, সে কারও বাধা মানেনি। এখন অনেকেই এ বাড়িটি দেখতে আসছে।’