বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সম্ভাবনার খাতটিই এখন সবচেয়ে সংকটে

  •    
  • ৭ এপ্রিল, ২০২১ ১০:৪০

পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত বছরের সাধারণ ছুটির ক্ষতিই এখন পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারা। তার ওপর এখন আবার লকডাউন, পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ রকম চলতে থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে বলে শঙ্কা তাদের।

প্রবাসীবহুল অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সিলেট। প্রবাসীবহুলতার পাশাপাশি এই অঞ্চলের মানুষের বিনিয়োগের অনাগ্রহও দীর্ঘদিনের। বিনিয়োগহীনভাবে ব্যাংকে টাকা ফেলে রাখার প্রবণতা রয়েছে এখানে।

তবে গত এক থেকে দেড় দশকে এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন এনেছে পর্যটন খাত। এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট। গত এক দশকে পর্যটক সমাগমও বেড়েছে। ছুটির দিনগুলোতে কোনো হোটেল-মোটেলে কক্ষ খালি পাওয়া যেত না।

পর্যটন খাতকেই সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাত হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সেটিই এখন সবচেয়ে বড় সংকটে।

পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত বছরের সাধারণ ছুটির ক্ষতিই এখন পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারা। তার ওপর এখন আবার লকডাউন, পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ রকম চলতে থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে বলে শঙ্কা তাদের।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েবের হোটেল ব্যবসা রয়েছে নগরীতে। শোয়েব বলেন, সিলেটে তেমন ভারী শিল্পকারখানা নেই। ট্রেডিং, পর্যটন আর আমদানি-রপ্তানিই এখানকার প্রধান ব্যবসা। এর মধ্যে পর্যটনকেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মনে করা হয়েছিল। করোনার কারণে এই খাতের ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ফাইল ছবি

বছর তিনেক আগে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের রাধানগর এলাকায় একটি দ্বিতল বাসা ভাড়া নিয়ে ‘হিমাচল’ নামে একটি ছোট্ট রিসোর্ট চালু করেছিলেন ঢাকার আজিজুর রহমান সাজু। ভালোই চলছিল রিসোর্ট। তবে সব ওলট-পালট করে দেয় করোনাভাইরাস।

গত বছর প্রায় ছয় মাস বন্ধ ছিল রিসোর্ট। এরপর চালু হলেও ব্যবসা আগের জায়গায় ফেরার আগেই আবার বাড়তে শুরু করে করোনার সংক্রমণ; দেয়া হয়েছে লকডাউন।

সাজু বলেন, ‘গত বছর বন্ধ থাকাকালীন মাসে আমার প্রায় এক লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। আমরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। গত বছরের লোকসানের ধকলই কাটিয়ে উঠতে পারিনি। অনেকের কাছ থেকে ঋণ করতে হয়েছে। এখন আবার লকডাউন এসেছে। পর্যটক সমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে রিসোর্টটি বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না।’

সিলেটের হোটেল-রিসোর্ট মালিকরা বলছেন, গত বছর সাধারণ ছুটি চলাকালে সিলেটের হোটেল-রিসোর্ট খাতে প্রতিদিন প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মাসে ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক শ কোটি টাকা। এবার আবার লকডাউনের কারণে দীর্ঘমেয়াদি লোকসানের মুখে পড়তে হবে।

জাফলং, বিছনাকান্দি, পাংথুমাই, রাতারগুলসহ সিলেটের বেশির ভাগ দর্শনীয় স্থানের অবস্থান গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এই উপজেলার প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, করোনায় গত বছরের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত পর্যটন বন্ধ থাকার পর নভেম্বর থেকে পর্যটক সমাগম বাড়তে শুরু করে। নতুন বছরে সবগুলো পর্যটন স্পটে প্রচুর পর্যটক আসছিলেন।

ফাইল ছবি

তবে তাতেও ব্যবসা বাড়েনি বলে জানালেন সিলেট হোটেল মোটেল রেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুমাত নুরী জুয়েল। তিনি বলেন, ‘করোনার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর গত তিন থেকে চার মাস সিলেটে অনেক পর্যটক এসেছেন। কিন্তু যারা বেড়াতে এসেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই তরুণ। আগে যেভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষ বেড়াতে আসতেন এবার তারা সেভাবে আসেননি।

‘যে তরুণরা এসেছেন তারা ঘুরেফিরে চলে গেছেন। হোটেলে থাকেননি। থাকলেও অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার হোটেলে থাকছেন। ফলে তিন ও চার তারকা মানের হোটেল ও রিসোর্টগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে। এর মধ্যে এখন আবার সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল।

সিলেটের পর্যটন খাতের উন্নয়নে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন হাসান মোরশেদ। তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পর্যটন সেক্টরের সংকট কাটবে না। কারণ, মানুষের আয় কমবে; ফলে খরচ কমাবে। আগের মতো পর্যটকরা আসবে না। এতে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে পর্যটন খাতের উদ্যোক্তাদের। এ কারণে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই করবে। ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।’

সিলেট হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, এই সংগঠনের সদস্যভুক্ত হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে ৩৪টি। তবে সিলেটে ছোট-বড় মিলিয়ে হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে দুই শতাধিক। সিলেট বিভাগে এই সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।

সিলেট বিভাগের পর্যটকদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। বছরজুড়েই এই উপজেলা শহরে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। গত অর্ধযুগে কেবল শ্রীমঙ্গল শহরেই গড়ে উঠেছে শতাধিক রিসোর্ট।

পর্যটন বদলে দিয়েছিল চায়ের জন্য বিখ্যাত এই শহরটির অর্থনীতি। তবে করোনায় কাহিল শ্রীমঙ্গলের পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা।

শ্রীমঙ্গলের ‘এসকেডি আমার বাড়ি’ রিসোর্টের পরিচালক সজল দাশ বলেন, ‘আমার ব্যাংক লোন আছে দুই কোটি টাকা। গত বছরের প্রায় ছয় মাস রিসোর্ট বন্ধ ছিল। দুই-তিন মাস কিছুটা ব্যবসা করেছি। এখন আবার বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। আয় না হলেও কর্মচারীদের বেতন, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা ঋণের জালে আটকে যাচ্ছি। পুঁজি হারানোর ভয়ে আছি।’

ফাইল ছবি

একই এলাকার ‘হোটেল মেরিনা’র পরিচালক নাজমুল হাসান মিরাজ বলেন, ‘আমার হোটেলটি ভাড়া নিয়ে করেছি। মাসিক ভাড়া ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কর্মচারীদের বেতনসহ মাসিক খরচ আড়াই লাখ টাকা। বর্তমান অবস্থায় ঋণে জড়িয়ে পড়েছি। সরকারের সাহায্য ছাড়া এই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারব না।’

ঈদ, পূজাসহ যেকোনো উৎসব বা সরকারি ছুটির দিনে অতিথিতে পূর্ণ থাকে এসব হোটেল-রিসোর্ট। তবে গত ঈদুল ফিতরের মতো বড় উৎসবেও পুরোপুরি ফাঁকা ছিল হোটেলগুলো। এবারও ঈদুল ফিতর আসন্ন। লকডাউনের কারণে ঈদ মৌসুমের ব্যবসা নিয়েও শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা।

শ্রীমঙ্গল শহরের ‘গ্রিনলিফ’ রিসোর্টের পরিচালক এস কে দাস সুমন বলেন, ‘২০১৯ সালে ঈদের এক মাস আগেই আমার রিসোর্টের সব কক্ষ বুক হয়ে যায়। এখানে বেশির ভাগ বিদেশি অতিথিরা আসেন। কিন্তু গত ঈদে পুরো ফাঁকা ছিল রিসোর্ট। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আগামী ঈদেও রিসোর্ট বন্ধ রাখতে হবে।’

উদ্যোক্তাদের মতো বিপাকে পড়েছেন পর্যটন খাতের কর্মীরাও। গত বছরের সাধারণ ছুটিতেই অনেকের চাকরি চলে গেছে। কম বেতনেও কাজ করছেন অনেকে। এ অবস্থায় আবার লকডাউন সংকট আরও বাড়াবে বলে আশঙ্কা তাদের।

পর্যটককে কেন্দ্র করে গত এক দশকে সিলেটে ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটেছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসারও। প্রায় ৫০০ ছোটবড় রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে শহরে। গত বছরের সাধারণ ছুটির ক্ষতি সামলাতে না পেরে অনেক রেস্টুরেন্টই বিক্রি হয়ে গেছে। বন্ধও হয়ে গেছে কয়েকটি।

ফাইল ছবি

নগরীর জিন্দাবাজার এলাকার জনপ্রিয় ‘পানসী’ রেস্টুরেন্টের ব্যবসায়িক অংশীদার নুরুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘গত বছর বিরাট লোকসান গুনতে হয়েছে। এরপর মাস ছয়েক খোলা থাকলেও ব্যবসা আগের জায়গায় যায়নি। এভাবে চলতে থাকলে অনেক রেস্টুরেন্টই বন্ধ করতে হবে।’

গোয়াইনঘাটের হাদারপাড় এলাকার ইঞ্জিন নৌকা চালক সমুজ মিয়া। হাদারপাড় থেকে পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দিতে নৌকা চালান তিনি। পর্যটকসমাগম নিষিদ্ধ করায় শঙ্কিত তিনিও।

সমুজ মিয়া বলেন, ‘গত বছরের এই সময়ের কথা মনে হলে এখনও আতঙ্কে ভুগি। জীবনে কখনও এ রকম বেকার হইনি। বিছনাকান্দিতে পর্যটকদের আনাগোনা সব সময় লেগে থাকে। আয় ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু গত চার থেকে পাঁচ মাস এখানে কোনো পর্যটক আসেননি। ফলে মানুষের সাহায্য-সহায়তা নিয়ে চলতে হয়েছে। এবারও এমন পরিস্থিতি হলে তো আর রক্ষা নেই।’

সিলেটের জেলা প্রশাসক এম. কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সবার আগে জীবন। আমাদের জীবনরক্ষায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসায়ীরাও নিশ্চিয়ই এটি উপলব্ধি করতে পারবেন। তাই আর্থিক ক্ষতি মেনে নিয়েও তারা এই মহামরি প্রতিরোধে আমাদের সহযোগিতা করছেন।

‘লকডাউন ঘোষণার আগেই ২ এপ্রিল থেকে সিলেটে বাইরের জেলা থেকে পর্যটকদের আগমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে।’

এ বিভাগের আরো খবর