বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় কোনটা সে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বেসরকারি হিসেবে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় সাফা হাফলং। এরপরে আছে যোগী জোথলাং, যোগী হাফং আছে চতুর্থ স্থানে। এদের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান ক্লাং, বাংলাদেশের ২৮তম উঁচু পাহাড়।
আমি এর আগে তাজিংডং বা বিজয় আর কেওক্রাডংয়ে বেশ কয়েকবার উঠেছি। সাফা হাফলং ও যোগী হাফংয়েও উঠেছি। বাকি ছিল যোগী জোথলাং। তাই এই বছর ফেব্রুয়ারিতেই এই পাহাড় জয়ের জন্য মনস্থির করলাম।
যারা এর আগে ট্রেকিং করেছেন বা করেন তারা জানেন, বাংলাদেশের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং ও থ্রিলিং রুট এটি। একটু অ্যাডভান্সড লেভেলের ট্রেকিংয়ের সুযোগ আছে এখানে।
থানচি থেকে রেমাক্রি হয়ে দালিয়ান পাড়ায় গিয়ে যোগী জোথলাং ও যোগী হাফংয়ের বেসক্যাম্প। সেখান থেকে যাওয়া-আসা মিলিয়ে যোগী জোথলাংয়ের দূরত্ব প্রায় ২৪ কিলোমিটার এবং যোগী হাফংয়ের প্রায় ২৬ কিলোমিটার।
খোঁজখবর করে জানলাম, একদিনে যোগী জোথলাং, যোগী হাফং ও আয়ান ক্লাং জয় করা সম্ভব। ঠিক করে ফেললাম, আমিও এই তিনটি একসঙ্গে জয় করব।
এখান থেকে দেখা যায় তিন পাহাড়ের চূড়া।
এমন সময় আমার বন্ধু সাদি ফোন করে বলল, ওর দলের আটজন আছে, তবে তারা আমার সঙ্গে শুধু যোগী জোথলাং পাহাড়ে যেতে চায়। কিন্তু ওদের সংকট হলো পাহাড়ের পথ চেনে এমন ভালো গাইড আর নৌকা নিয়ে। সেই দায়িত্ব আমি নিলাম।
বললাম, ‘আমার লক্ষ্য কিন্তু এবার এক অভিযানেই তিন পাহাড় জয়ের। সঙ্গে নেব বাংলাদেশের পতাকা আর আমার প্রিয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি ট্যুরিস্ট সোসাইটির (ডিইউটিএস) পতাকা।’
শুনে সাদি বলল, ‘আমরা প্রথমে সবাই মিলে যোগী জোথলাং পাহাড়ে উঠব। সেখান থেকে দলের এক অংশ নেমে আসবে সোজা দালিয়ান পাড়ায়। বাকি আমরা তিনজন মানে তুমি, আমি আর আরিফ তোমার সাথে তিন পাহাড় জয়ের অভিযানে যাব।’
তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। পাহাড় জয়ী তিন সদস্যের এই ছোট্ট দলটিকে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলও বলা যায়।
১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। ঢাকা থেকে বাসে রওনা দিয়ে ২০ তারিখ সকালে বান্দরবান নামলাম।
সকালের নাস্তা করে আমাদের রিজার্ভ করা জিপে রওনা হলাম থানচির পথে। থানচি পৌঁছে আমাদের গাইডকে নিয়ে দলের সবার নামের লিস্ট জমা দিয়ে থানায় ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ক্যাম্পে রিপোর্ট করে, দুপুরের ভাত কোনোমতে নাকে মুখে গুঁজে আমাদের রিজার্ভ নৌকায় চড়ে বসলাম।
রেমাক্রিতে নৌকা থেকে নামার পর।
সেই নৌকা আমাদের রেমাক্রি নামালো বিকেল চারটায়। গরম গরম চা, বিস্কিট, কলা খেয়ে সদলবলে হাঁটা দিলাম দালিয়ান পাড়ার দিকে। সন্ধ্যা ছয়টায় সেখানে পৌঁছালাম। এটা একটা বম পাড়া। কাজেই থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে।
রাতে পাহাড়ি মুরগি রান্না হলো। ভাত আর মুরগির মাংস খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঠিক হলো পরদিন ঠিক ভোর চারটায় রওনা দেব। এর মধ্যে পাড়া থেকে স্থানীয় গাইডও ঠিক করে রাখা হয়েছে।
২১ তারিখে সকালে উঠে সদলবলে রওনা হতে হতে চারটা চল্লিশ বেজে গেল। কেউ আর নাস্তা না করে প্রতেকের জন্য তিনটা করে সিদ্ধ ডিম নিজ নিজ পকেটে নিয়ে নিলাম। চলার পথে এই সিদ্ধ ডিমই খেয়ে নেব।
পাড়া থেকে বের হয়ে ঘন জঙ্গল পার হয়ে ঊর্ধ্বমুখী আমাদের পথ। ওয়াই জাংশন পার হয়ে ডানের রাস্তা ধরে ঝিরিতে নামলাম। এখান থেকে পথ একদম পাথুরে। বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই ও শুকনো ঝরনা পাড়ি দিয়ে শুধু উপরের দিকে ক্রমাগত উঠে চলা। এর মাঝেই শুরু হলো বাঁশঝাড়। একজন কোনোমতে উপরে উঠে যেতে পারে, এমন সরু রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে উঠতে গিয়ে দুইবার পায়ের রগে টান খেলাম। কিন্তু থামলাম না। ধীরে ধীরে চলতে লাগলাম।
দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা নয়জন একসঙ্গে যোগী জোথলাং পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছালাম। এখানে সামিট নোট লিখে, জাতীয় পতাকা ও ডিইউটিএসের পতাকা নিয়ে আমরা ছবি তুললাম।
দলের বাকি ছয়জন একটা গাইড নিয়ে এখান থেকে ফেরত যাবে দালিয়ান পাড়া। তাই ওদের তেমন তাড়া নেই। কিছুক্ষণ পাহাড়ের চূড়ায় বসে ছবি তুলল।
আমি গাইডদের সঙ্গে দ্রুত ভাত খেয়ে পায়ের জন্য একটা পেইন কিলার খেয়ে নিলাম।
সাদি বলছিল, ‘আনোয়ার, তুই এখনও ভেবে দেখ, পারবি তো?
কিন্তু সাহস না হারিয়ে আমরা তিনজন বাকিদের বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম। বাকি দুই পাহাড়ও জয় করতে হবে।
এরপর প্রায় চল্লিশ মিনিট রিজ লাইন ধরে এঁকেবেঁকে বাঁশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটার পর একসময় এসে পড়লাম আয়ান ক্লাং পাহাড়ের চূড়ায়। এখানেও সামিট নোট লিখে জাতীয় পতাকা আর ডিইউটিএসের পতাকা নিয়ে ছবি তুললাম। পাঁচ মিনিট বসে জিরিয়ে নিয়ে আবার উঠে পড়লাম। এবার লক্ষ্য যোগী হাফং।
এই পথেই এগোতে হয়েছে যোগী হাফং-এর পথে।
এখান থেকে আমরা রিজ লাইন ধরে হাঁটছিলাম। চারদিকে যতদূর চোখ যায় সব শুধু বাঁশের জঙ্গল। বাঁশগাছের খোঁচায় আমাদের হাত-পা কেটে যাছিল, রক্ত পড়ছিল। কিন্তু এখন থামার মতো সময় নেই। সূর্য ডোবার আগেই আমাদের যোগী হাফং সামিট করতে হবে। একজনের পেছনে আরেকজন হাঁটছি। একজনের বেশি এই রাস্তায় হাঁটা যায় না। যাদের উচ্চতা ভীতি আছে তাদের এই রাস্তায় না আসাই উচিত।
অবশেষে বিকেল চারটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম যোগী হাফং। এখানেও আগের মতোই ছবি তুলে, পাঁচ মিনিট মতো বিশ্রাম নিয়ে দালিয়ান পাড়ার জন্য হাঁটা দিলাম।
সূর্য ডূবে গেলে যার যার হেড ল্যাম্প জ্বালিয়ে মাথায় লাগিয়ে আবার একই পথে নামতে শুরু করলাম। কিন্তু এই সময় হলো এক বিপদ। সবার খাবার পানি শেষ। পিপাসা চেপে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম।
আরিফ ভাই আমাদের মিনি চকলেট বার আর সেন্টার ফ্রেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাতে একটু এনার্জি পাচ্ছিলাম। এভাবে তিন ঘণ্টা দ্রুত চলার পর প্রথম যেখানে পানি পেলাম, সেই পানি খাওয়ার উপযুক্ত না। তবুও সেই পানিতেই স্যালাইন মিশিয়ে খেলাম। এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। এরপর দশ মিনিট রেস্ট নিয়ে আবার নামা শুরু করলাম।
দালিয়ান পাড়ায় পৌঁছাতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। এসে শুনলাম আমাদের দলের বাকি ছয়জন পাড়ায় পৌঁছেছে রাত আটটায়। ওরা গোসল করে, গরম ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েছে। আমরাও গোসল করে, গরম ভাত খেয়ে দ্রুত শুয়ে পরলাম। ক্লান্তিতে সাথে সাথেই সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ফেরার আগে দালিয়ান পাড়ায় পুরো দল।
পরদিন সকালে নাস্তা করে, সব হিসাব নিকাশ চুকিয়ে সকাল নয়টায় রওনা দিলাম রেমাক্রি। বেলা বারোটা নাগাদ রেমাক্রি পৌঁছে দেখি আমাদের রিজার্ভ রাখা নৌকা চলে গেছে। অগত্যা বেশি ভাড়া দিয়ে নৌকা নিয়ে থানচি বাজার পৌঁছালাম সন্ধ্যা ছয়টায়। দ্রুত খাওয়া সেরে রিজার্ভ জিপে রওনা হলাম বান্দরবান। সেখানে রাতের খাওয়া সেরে রাত ১১টায় ঢাকার বাসে উঠলাম।
২৩ তারিখ সকালে সবাই ঢাকা পৌঁছালাম। সঙ্গীদের বিদায় জানিয়ে যার যার ঘরে ফিরলাম।
ফেরার সময় ভাবছিলাম, প্রথমে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও ঠিকই একদিনে তিন পাহাড় জয় করেছি। এতে মনোবল যেন আরও বেড়ে গেছে।
ভাবছি, আবার কবে যাব একদিনে কোন তিন পাহাড় জয়ে?
এই ট্রেকিংয়ে যা যা সঙ্গে নেবেন
- ভালো মানের ব্যাকপ্যাক যা দ্রুত পিঠ ঘামিয়ে তুলবে না এবং পিঠের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে না।
- ব্যাকপ্যাকের সঙ্গে রেইন কভার।
- ট্রেকিং প্যান্ট
- ভালো গ্রিপের ট্রেকিং স্যান্ডেল
- স্লিপিং ব্যাগ বা পাতলা কম্বল
- হ্যান্ড গ্লাভস
- হেড ল্যাম্প
- ২ থেকে ৩টি টি-শার্ট (হাফ এবং ফুল স্লিভ)
- ট্রাউজার
- ট্রেকিং পোল। না থাকলে পাড়া থেকে বাঁশ নিয়ে নেয়া যায়।
- মোজা
- ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় জিনিস
- পানির বড় বোতল
- ওষুধ, স্যালাইন, গ্লুকোজ
- ওডোমস
- জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি
- মোবাইলের পাওয়ার ব্যাংক
- শীতের কাপড়