এখন শহরে তো বটেই গ্রামগঞ্জেও ইট ও সিমেন্টের দালানের ভিড়। অথচ একসময় গ্রামের বিত্তবানরা মাটির দেয়াল দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করতেন। এমনই একটি বিশাল দোতলা বাড়ি আছে নওগাঁর মহাদেবপুরের আলীপুর গ্রামে।
মাটির তৈরি বাড়িটিতে ১০৮টি কক্ষ আছে। সেখানে ৪০ জনের বসবাস। বাড়িটি দেখতে প্রতিদিনই আসেন দর্শনার্থীরা।
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম আলীপুর। এই গ্রামের তাহের আলী মণ্ডল ও তার ছোট ভাই শমসের আলী মণ্ডল শখ করে ওই বাড়ি নির্মাণ করেন। তারা দুজনই প্রয়াত। তবে বাড়িটিতে তার ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিরা বাস করছেন।
১৯৮৬ সালে একটি পুকুর খনন করে সেই মাটি দিয়েই প্রায় ছয় বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করা হয় দোতলা এই বিশাল বাড়ি। এটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয় মাটি, খর, তালগাছের তীর, বাঁশ, টিন ও কাঠ।
বাড়িটির দৈর্ঘ্য ৩০০ ফুট ও প্রস্থ ১০০ ফুট। মাটির দেয়ালে চুন ও আলকাতরার প্রলেপ দেয়া হয়েছে। সামনেই আট বিঘা আয়তনের বিশাল পুকুর। আর আঙিনার আয়তন তিন বিঘা। গাছগাছালিতে ঘেরা বাড়িটি নিরিবিলি। বাড়িটি দেখতে পর্যটকদের আনাগোনা থাকছেই।
মহাদেবপুরের চেরাগপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে দেখা মিলবে বাড়িটির। ছবি: নিউজবাংলানওগাঁ শহরের থানার মোড় থেকে বাড়িটি দেখতে এসেছেন রাজু হোসেন। তিনি বলেন, ‘লোকমুখে এই মাটির বাড়িটির কথা শুনেছি। তবে নওগাঁয় বসবাস করলেও আগে কখনও আসা হয়নি। এবারই প্রথম বাড়িটি দেখতে আসলাম। বর্তমানে তো ইট-পাথর দিয়ে বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। মাটির বাড়ি খুব একটা চোখে পড়ে না। তা ছাড়া একসঙ্গে ১০৮টি ঘর। যা দেখে খুবই অবাক হয়েছি। দেখে মনটা জুড়িয়ে গেছে।’
পাশের বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার সান্তাহার থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন ব্যাংক কর্মকর্তা সুরাইয়া খাতুন সেফা। তিনি বলেন, ‘পরিবার নিয়ে ঢাকাতে থাকি। কয়েক দিনের জন্য ছুটিতে এসেছি। এই ফাঁকে বাড়িটা দেখতে এসেছি। এত বিশাল বাড়ি আমি আগে কোনো দিন দেখিনি। আর দেশে মাটির তৈরি ১০৮ কক্ষের আর কোনো বাড়ি আছে কি না আমার জানা নেই। বাড়িটা দেখে খুব ভালো লেগেছে।’
তিনি আরও বলেন, এটি একটি পর্যটন এলাকা হতে পারে বাড়িটি ঘিরে। সরকার যদি বাড়িটির আশপাশে বসার জায়গা, ঘুরতে আসাদের নিরাপত্তাসহ যোগাযোগব্যবস্থা আরও উন্নত করতে পারে তাহলে আরও বেশি মানুষের সমাগম হবে।
মাটির দেয়ালে চুন ও আলকাতরার প্রলেপ দেয়া। ছবি: নিউজাবাংলানওগাঁর সদর উপজেলার বোয়লিয়া এলাকা থেকে আসা শাকিরুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেই না মাটি দিয়ে দোতলা বাড়ি তৈরি করা যায়। আমি নিজেও এখানে না এলে জানতামই না যে মাটি দিয়ে এত বিশাল একটা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে এসে আমার সন্তানদের ঘুরে-ঘুরে দেখালাম।’
বাড়িটির মালিক প্রয়াত শমসের আলী মণ্ডলের ছেলে ফারুক হোসেন মণ্ডল জানান, ‘১৯৮৬ সালে আমার বাবা ও চাচা প্রয়াত তাহের আলী আকন্দ অনেকটা শখের বশে বাড়িটি নির্মাণ করেন। এ জন্য তারা মোট ১৭ বিঘা জমি নির্ধারণ করেন। আট বিঘা জমিতে পুকুর খনন করেন মাটি ও পুকুরের জন্য এবং ছয় বিঘা জমিতে বাড়ি নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৫০ জন শ্রমিক কাজ করেছিলেন। পুরো বাড়ি নির্মাণে সময় লাগে প্রায় ৯ মাস।
তিনি আরও বলেন, ‘১০৮ কক্ষের এই বাড়িতে প্রবেশের বড় দরজা আছে সাতটি। তবে প্রতিটি ঘরে রয়েছে একাধিক দরজা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে ১৮টি। ৯৬টি বড় ও ১২টি ছোট কক্ষ রয়েছে বাড়িতে।’
প্রয়াত তাহের আলী মণ্ডলের নাতি সাকিব আলী মণ্ডল বলেন, ‘আমার দাদাদের অনেক শখের এই বাড়ি। এর চারপাশে এক চক্কর দিতে ছয় থেকে আট মিনিট লাগে। বর্তমানে বাড়িটিতে আমার বাবা, চাচা ও ফুফুদের পরিবার মিলে ৪০ জন বসবাস করছি।’
দোতলা এই মাটির বাড়িতে কক্ষ আছে ১০৮টি। ছবি: নিউজবাংলাতিনি বলেন, ‘বাড়িটি ঘিরে দাদাদের অনেক স্মৃতি জমা আছে। তাই আমরা এই মাটির বাড়ি কখনও ভাঙব না। দাদাদের স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়িতেই আমরা বসবাস করে যেতে চাই।’
স্থানীয় চেরাগপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শিবনাথ মিত্র বলেন, ‘আলীপুরের এই মাটির বাড়ি দেখতে প্রতিদিনই অনেক মানুষের সমাগম হয়। এ ছাড়া সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নওগাঁ এলে বাড়িটি দেখতে চাইলে আমি তাদের নিয়ে যাই। সাধারণ মানুষ যাতে সহজে যেতে পারে সে জন্য নওগাঁ-মহাদেবপুর রোডের পাকা রাস্তা থেকে আলীপুর ওই বাড়ি পর্যন্ত এসবিবি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে ইউপির উদ্যোগে।’