পুঠিয়া রাজবাড়ির মাঠ। ক্রিকেট খেলছে স্থানীয় ছেলেরা। তাদের একজন আবার পকেটে ফুল নিয়ে বল করছে।
ছেলেটার কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘তুমি ফুলগুলো কোথায় পেলে?’ তার সরল উক্তি, ‘খুব সুন্দর দেখতে। তাই এসব আমি একটা অটোরিকশা থেকে নিয়ে এসেছি।’
‘এই ফুলগুলো আমার’ বলতেই সে কিছু না বলে সব ফুল ফেরত দিল।
আখের ফুল। এসব আমি কাছের আখ ক্ষেত থেকে তুলে এনেছি। নাটোর থেকে পুঠিয়া আসতে আমরা পথে পথে অনেক আখ খেতের দেখা পেয়েছি।
ছবি তুলেছি; সঙ্গে ফুলও তুলেছি। সেসব ফুলই ছেলেটি আমাদের অটোরিকশা থেকে নিয়েছিল।
২
শীতের মধ্যে আমরা নাটোর ঘুরতে এসেছি। ভোর পাঁচটায় যখন ন্যাশনাল ট্রাভেলসের গাড়ি ভিআইপি হোটেলের ফটকে থামল, তখন ঠান্ডায় শরীর জমে গেছে। কোনো রকমে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম। সে ঘুম ভাঙল দুপুর ১২টায়।
তখনও প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে মোড়া; ঘোর ঘন কুয়াশা যাকে বলে। আস্তে-ধীরে তৈরী হয়ে বের হলাম। কই যাব করতে করতে ফারুকের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চড়ে বসি।
ফারুক আমার পূর্ব পরিচিত। নাটোরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ব্যবসা প্রথম তিনিই শুরু করেন। এখন অটোরিকশা নাটোরের পথে পথে অনেক। তবু আমি এখানে এলেই ফারুকের খোঁজ করি। সেও যেখানেই থাকুক, আমার ডাকে সারা দিয়ে চলে আসবেই।
আজ ফারুক আমাকে নিয়ে চলেছে পুঠিয়া রাজবাড়িতে। এখানে পথ চলতে পথের দুই ধারে আখ ক্ষেত চোখে পড়ে। আরও চোখে পড়ে একটু পরপর আখবোঝাই গাড়ি।
পথ চলছি, ছবি তুলছি। এভাবেই আখ ক্ষেতে আখের মাথায় ফুল দেখে ফারুককে তার অটোরিকশা থামাতে বলি। তারপর ক্ষেতের আল ধরে একেবারে আখ ক্ষেতের ভেতরে যাই।
৩
ছোটবেলায় আদর্শ লিপিতে পরেছি ইক্ষুর রস অতি মিষ্ট। সেই অতি মিষ্ট ইক্ষুকে কেউ কেউ বা কোথাও বলে গেন্ডারি। ১২ বছরের দুই শিশু আখ ক্ষেতে আখ ছিঁড়ে খাচ্ছিল। তারা আমাকে দেখে কাছে আসে।
আমাকে আখের ফুলে হাত বুলাতে দেখে বলে, ‘আপনি কুইশাল দিয়ে কী করবেন?’ আমি ‘কিছু না’ বলে ছবি তুলতে উদ্যত হতেই তারা সমস্বরে বলে ওঠে, ‘তাইলে আগে আমাগো ছবি তুইলা দেন।’
কী আর করা। ওদের ছবি তুলে দিয়ে আমি আখ ফুলের ছবি তুলি। তারপর ক্ষেতমালিক সলিম মিয়ার সঙ্গে কথা বলি।
এই আখ খাওয়ার জন্য নয়। তবে কেউ তা খেলেও আসলে এসব চলে যায় চিনিকলে। মূলত এই আখ থেকে চিনি তৈরি হয়; হয় গুড়ও। এসব সলিম মিয়ার কথা।
আমি তার সেসব কথার চাইতে আখ ফুল নিয়ে ভাবছি। মিথ্যা বলে কী হবে, আমি জীবনে প্রথমবার আখ ফুল দেখলাম। আখ ফুল দেখে আমি যারপরনাই অভিভূত। সে অনুভুতি নিয়ে পথ ধরি পুঠিয়া রাজবাড়ির।
৪
নাটোর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহীর পুঠিয়ায় অবস্থিত বিখ্যাত পুঠিয়া রাজবাড়ি। এখানকার পিচঢালা পথের সৌন্দর্যে মন ভরে যায়। রাস্তার দুই পাশের আখ ক্ষেতের কথা আগেই বলেছি; রয়েছে শর্ষে ক্ষেতও।
তবে এই শীতেও আমাদের কিছু বিবর্ণ কাশফুলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বিষয়টা অবাক করার মতো। সে অবাক করা ভাব বুকে থাকতেই দেখি সারি সারি ভ্যান গাড়ি। আর সে ভ্যানগাড়িতে মাটির হাঁড়ি।
এভাবেই আমরা আধা ঘণ্টায় ফাঁকা রাস্তা, ক্ষেত আর ছোট ছোট গঞ্জ পেরিয়ে পুঠিয়া বাজারে পৌঁছাই। এখান থেকেই শুরু পুঠিয়া রাজবাড়ির পথ। এ পথে প্রবেশের পরপরই বিশাল আকারের পুকুরের পাশে এই উপমহাদেশের বৃহত্তম শিবমন্দিরটির অবস্থান।
চমৎকার কারুকার্যময় পুকুর ঘাট পেছনে ফেলে দাঁড়িয়ে শিবমন্দিরটি। রানী ভুবন মোহিনী দেবী এই শিবমন্দির নির্মাণ করেন।
আমরা শিবমন্দিরের ভেতর প্রবেশ করি। মন্দিরের কক্ষ মাত্র একটি। সে কক্ষে রয়েছে শিবলিঙ্গটি। কিন্তু ভর দুপুরে সে কক্ষটিতে তালা ঝুলতে দেখে মন খারাপ হওয়ার উপক্রম হতেই পাশের তরকারি বিক্রেতা এগিয়ে আসেন।
তিনি মন্দির রক্ষক বিশ্বনাথ দাসের বাড়ি দেখিয়ে বললেন, ‘আপনি ডাকলেই তিনি চলে আসবেন।’ সত্যি তাই হলো। বিশ্বনাথ এসে মন্দিরের কক্ষটি খুলে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন মন্দিরের ইতিহাস আর নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু।
এখানে আমরা নকশাখচিত শিবলিঙ্গ দর্শন করলাম। আর ঘুরে দেখলাম পুরো মন্দির এলাকা।
৬৫ ফুট দীর্ঘ বেদির ওপর শিবমন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের দুই দিক দিয়েই সিড়ি আছে। চারিদিকে বিশাল বারান্দা। বারান্দার দেয়ালের গায়ে হিন্দু পুরানের ১৪টি চিত্র। এসব চিত্র এখন নামমাত্র আছে। কারণ সবকিছুই ভেঙে গেছে।
তবে এখনও এখানে শিবপূজা ঠিকই হয় প্রতি বছর। আর দূর-দুরান্ত থেকে হাজারো মানুষ ছুটে আসেন। আমরা চমৎকার গম্বুজ শোভিত শিব মন্দির দর্শন শেষে বিশ্বনাথ বাবুকে বিদায় জানিয়ে হেঁটে পুঠিয়া রাজবাড়ি চলে আসি।
৫
আমাদের সামনে এখন পুঠিয়া রাজবাড়ির বিশাল মাঠ; পেছনে দোলমঞ্চ। পিরামিড আকৃতির দোলমঞ্চটি চমৎকার।
আমরা দোলমঞ্চ ঘুরে দেখে রাজবাড়ির দিকে যাই। রাজবাড়ির মাঠে এলাকার ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে, গরু চড়তেও দেখা গেল। সাথে বিয়ে বাড়ির প্যান্ডেল করা, বরযাত্রী এসেছে।
১৯৭৩ সালে এই বিশাল রাজবাড়িটিতে পুঠিয়া ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা লস্করপুর ডিগ্রি বিদ্যা নিকেতন নামে পরিচিত। ডিগ্রি কলেজের সাইনবোর্ডটি এখন আর নেই।
রাজবাড়িটির সংস্কারমূলক কাজ চালানো হয়েছে, গায়ের নতুন রং দেখেই তা বোঝা যায়। শুক্রবার বিধায় আজ দর্শনাথীদের সংখ্যাও কম নয়। আমরা ইট আর সুড়কির তৈরী রাজবাড়িটি ঘুরে দেখি। চমৎকার দোতলা বাড়িটি গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে নির্মিত। এর সুন্দর কারুকার্যময় কাঠের দরজা-জানালা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
পুঠিয়া রাজবংশের রাজা পাঁচআনী জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ। পরবর্তী সময় তার মৃত্যুর পর দত্তক পুত্র হরেন্দ্র নারায়ণ এখানকার রাজা হন।
হরেন্দ্র নারায়ণের পর তার পুত্র যোগেন্দ্র নারায়ণ জমিদারির দায়িত্ব নেন। যোগেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী শরৎ সুন্দরী রাজ্যভার গ্রহণ করেন।
রানী হেমন্তকুমারী দেবী তার শাশুড়ি মহারানী শরৎ সুন্দরী দেবীর সম্মানার্থে ১৮৯৫ সালে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
শেষ কথা
পুঠিয়া রাজবাড়ি চত্বর বিশাল। এখানে রয়েছে চারদিক পরিখাবেষ্টিত পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দির, জগদ্বাত্রী মন্দির, কালীমন্দির ও গোপাল মন্দির। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ভান্ডার এই পুঠিয়া রাজবাড়িটি দেখলেই বোঝা যায় চরম অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে।
কোনো সংস্কার নেই। অবশ্য সারা দেশের চিত্রটাই এমন।
পুঠিয়া রাজবাড়িতে বেড়াতে আসা দশনার্থীদের কৌতূহল মেটাতে নেই কোনো গাইডের ব্যবস্থা বা তথ্য কেন্দ্র।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালেই বুঝতে পারব, তারা ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে কত যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে চলেছেন। আমরাই কেবল তার ব্যতিক্রম। নিজের স্বার্থে দখল করি, ধ্বংস করি। এমন যদি চলতে থাকে, তাহলে একদিন এসব ইতিহাস বিলুপ্ত হবে।
পুঠিয়া রাজবাড়ির পথ
আমরা নাটোর হয়ে পুঠিয়া গিয়েছি। এখান থেকে সময় কম লাগে। বাসে মাত্র ১৫ মিনিট। রাজশাহী হয়েও পুঠিয়া যেতে পারেন। কলাবাগান, কল্যাণপুর বা গাবতলী থেকে ভোর পাঁচটায় শুরু হয়ে রাত একটা পর্যন্ত বাস পাওয়া যায়।
ন্যাশনাল ট্রাভেলসের বাসে যেতে আগেই বুকিং দিয়ে রাখতে হবে। এ ছাড়া হানিফ ও শ্যামলী পরিবহনের বাস ও এই পথে চলে।
নাটোরে থাকতে পারেন হোটেল ভিআইপি কিংবা হোটেল আরপিতে। রেস্তোরাঁর প্রসঙ্গ এলে অনেকেই বলবেন ইসলামিয়া পচুর হোটেলের কথা। তা ছাড়া নয়ন হোটেলেও খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন। হোটেল ভিআইপিতে দেশীয় খাবারের সঙ্গে চায়নিজ খাবারের ব্যবস্থা আছে।
নাটোরে গিয়ে কাচাগোল্লা না খেয়ে আসবেন, তা কী হয়? কাচাগোল্লা খেয়ে সঙ্গে নিয়েও আসুন।
নাটোরে দেখারও আছে অনেক কিছু। রাজবাড়ি, দিঘাপাতিয়ায় উত্তরা গণভবন এবং চলন বিল এগুলোর অন্যতম।