পয়সা গত হয়েছে সেই কবে। এক বা দুই টাকার প্রাণও নিভু নিভু। রাস্তার পাশের এই দোকানে এক টাকার কয়েন থাকে কদাচিৎ। খুচরার অভাবে এক বা দুই টাকার বিনিময়ে দেয়া হয় ক্যান্ডি।
অথচ কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া বাজারে এক টাকা না, এরও অর্ধেক মূল্যের হিসাব হয়। একটি পুরির দাম সেখানে ৫০ পয়সা। আর পেঁয়াজু পাওয়া যায় এক টাকায়।
কেরানীগঞ্জের আটিবাজার থেকে ছয় কিলোমিটার ভেতরে এই কলাতিয়া বাজার। সেখানকার মানিক ভাণ্ডারি এক পরিচিত মুখ। তার দোকান ‘হোটেল মানিক ভাণ্ডার’-এ ভিড় থাকে নিত্য।
২২ বছর আগে মানিকের বাবা ফইজউদ্দিন মিয়া নিত্যপণ্যের ব্যবসা করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর রাজধানী নাখালপাড়ার এক পুরি-পেঁয়াজুর কারিগরের পরামর্শে মানিক চালু করেন তার দোকানটি।
এই ২২ বছরে দেশ পাল্টে গেছে অনেক। কিন্তু পাল্টায়নি মানিকের পুরির দাম। শুরু থেকেই ৫০ পয়সা।
মানিক প্রতিদিন পুড়ি বিক্রি করেন পাঁচ কেজি ময়দার। ভেতরে দেয়া থাকে আলু ও ডালের মিশ্রণ। পেঁয়াজু তৈরি হয় শীল-পাটায় বাটা খেসারির ডাল ও দেশি পেঁয়াজ কুচি দিয়ে।
মানিক ভাণ্ডারি বলেন, উপকরণের দাম বাড়লেও তার পণ্যের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।
এক টাকার নোট যেখানে সহজলভ্য নয়, সেখানে কেউ যদি একটি পুরি খেতে চায়?
মানিক বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় ছাইড়া দেই। ডেইলি অনেক যায়। আমি খুশিই হই।’
দাম না বাড়লেও মানিকের খরচ বেড়েছে অনেক। শুরুতে দোকান ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা, দেয়া লাগেনি কোনো আগাম জামানত। সেই ভাড়া এখন আড়াই হাজার টাকা। তিন বছরের চুক্তি করতে জামানত দিতে হয়েছে লাখ টাকা। তাকে সাহায্য করেন ছোট ছেলে শুভ মিয়া ও কারিগর মিলন মিয়া।
‘তাহলে পোশায় কীভাবে?’
দোকানে গেলে দেখেই জবাব মিলবে প্রশ্নের। সকাল ছয়টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পরোটা, ভাজি বিক্রি হয়। তিন ঘণ্টার বিরতি নিয়ে তিনটা থেকে আটটা পর্যন্ত দম ফেলার ফুসরত হয় না মানিক ও তার সহকারীদের। ক্রেতা আসছে, প্লেটে উঠে যাচ্ছে পুরি, পেঁয়াজু। সঙ্গে আবার বিনামূল্যের সস।
সরিষা বাটা, ধনে পাতা, কাঁচামরিচ, দই, তেঁতুল, চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই টক। আবার পেঁপে-শসা কুচি করে তৈরি হয় সালাদ।
‘দুর্মূল্যের বাজারে এই দামে এতকিছু কীভাবে দেন?’
মানিক বলেন, ‘আল্লাহ চাইলে কী না হয়! আমার বেচা-বিক্রি বেশি। এলাকার মানুষ ছাড়াও দূরেত্তেও ম্যালা মানুষ আহে। সবতে বেশি আহে এলাকার পুলাপাইন।’
‘৫০ পয়সা এখন দেশে অচল। যদি কেউ একটা বা তিনটা পুরি খায় তবে কীভাবে দাম রাখেন?’
এই প্রশ্নের উত্তরে মানিক বলেন, ‘অনেক সময় পোলাপাইন আইলে তাগো ফ্রিতেই খাওয়াই। দুই-একটা পুরি খায়া গেলে আমার ব্যবসার কিছুই অয় না।’
দোকানে ঢুকে চোখে পড়ে দুই বন্ধুকে। তারা ঢাকার বংশাল থেকে ওই এলাকায় কাজে গিয়েছিলেন। এত সস্তায় খাবার দোকানের খোঁজ পেয়ে অবাক হন।
তারেক বলেন, ‘এই যুগে এক টাকা ফকিরকে দিলে নিতে চায় না। কিন্তু এই যায়গায় ৫০ পয়সায় পুরি ও এক টাকায় পেঁয়াজু পাওয়া যায়, এটা আশ্চর্যের ব্যাপার। খেয়েও মজা পাচ্ছি, মানও ভালো।’
মানিক মিয়া বলেন, ‘আমাগো দোকানের সব খাওয়ন পরিষ্কার। মাইনষেরে খাওয়াইলে ভালো জিনিস খাওয়ামু। আমি নিজেও যা খাই, তাই খাওয়ামু।’
বাবার মুদি দোকানের ব্যবসা ধরে রাখেননি মানিক। তবে আশা, সন্তান ধরে রাখবে তার ব্যবসা।
তিন বলেন, ‘আমার অন্য পোলাগো কথা কইতে পারি না। তয় ছোট পোলা ব্যবসা ধইরা রাখব, এই বিশ্বাস আছে।’
বাবার সঙ্গেই থাকে ছেটে ছেলে শুভ মিয়া। বয়সে এখনো কিশোর। তার ইচ্ছা, ব্যবসাটাকে আরও বড় করার।
শুভ বলে, ‘আমার ভাইয়েরা চায় না ব্যবসা করতে। তারা অন্য কাম করে। তয় আমার ইচ্ছা আছে আব্বার কামটা ধইরা রাখার।’
শুভ এই দোকানের পাশাপাশি নিজেরও একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। পাশেই সবজির একটি দোকান দিয়েছে সে। একসঙ্গে দেখে দুটোই।
এই দোকানে কারিগরের কাজ করেন মিলন মিয়া। ১১ বছর বয়সে যোগ দেন কাজে। এখন বয়স ৩১ বছর। মাঝের চারটি বছর কেটেছে লেবাননে।
২০ বছর আগে ৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু। এখন দিনেই পান এই পরিমাণ পারিশ্রমিক।
বলেন, ‘মানিক ভাণ্ডারি আমার মহাজন না, বড় ভাইয়ের লাগান। আমার পরিবারের দশা দেইখ্যা কাম দিছিলেন। লেবানন থাইক্যা ফিরার পরেও হে আমায় কাজ দিছে।’