প্রকৃতি সংলগ্ন জীবনযাপনকে উৎসাহিত করতে নেদারল্যান্ডসের একটি শহর সাজানো হচ্ছে নতুন করে। এর অংশ হিশেবে ৯০০ বছরের পুরনো একটি খাল পুনরায় খনন করা হয়েছে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই খালটির জায়গায় গাড়ি চলাচলের রাস্তা ছিল। সত্তরের দশকে ক্যাথারিজনেসিনগেল নামের খালটি ভরাট করে ১২ লেনের এই রাস্তা তৈরী করা হয়েছিল।
রাইন নদীর তীরে অবস্থিত ইউট্রেচট শহরটি উত্তর নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্র। ১১২২ সালে নগরের মর্যাদা লাভ করা ইউট্রেচটের যোগাযোগের প্রধানতম উপায় ছিল নৌপথ। মধ্যযুগের বাস্তবতায় নিরাপত্তার স্বার্থে পুরো নগরকে বেষ্টন করে পরিখা খনন করে হয়েছিল। শহরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত কয়েকটি খাল এই পরিখার সাথে সংযুক্ত ছিল। খাল ভিত্তিক যোগাযোগকে কেন্দ্র করেই শহরের বাড়িঘরগুলি নির্মিত হয়েছিল।
গত পঞ্চাশের দশক থেকে নেদারল্যান্ডসে এমন একটি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নেয়া হয় যেখানে জলপথের জায়গায় রাস্তা নির্মাণ করা হবে। যদিও ডাচ সরকারের উদ্যোগে জলপথের একটি অংশ সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত শপিং সেন্টারে আসা গাড়িগুলোর চলাচলের সুবিধার জন্য ক্যাথারিজনেসিনগেল খাল ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
খালটি ভরাট করার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় থেকেই শহরের অনেক বাসিন্দা এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। রাস্তা চালু হওয়ার পরও সিনগেল খালকে ফিরিয়ে দেবার দাবি ক্রমশ বাড়ছিল।
শহরের কেন্দ্রকে নতুন করে সাজানোর জন্য ১৯৯০ সালে একটি মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়। এই পরিকল্পনার ভিতরে ওয়ারডসিনগেল ও ক্যাথারিজনেসিনগেল খাল দুটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টিও অর্ন্তভুক্ত ছিল। ২০০২ সালে শহরের বাসিন্দারা ‘মহাপরিকল্পনা’ নিয়ে এক গণভোটে অংশ নেন। এরপরে কয়েক বছর ধরে চলা খনন কাজ শেষে গত শনিবার খালটিকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
গাড়ি নিয়ে সহজেই শপিং প্লেসগুলোতে যাওয়ার জন্য খালটি ভরাট করা হয়েছিল। এখন খালের জলপথটি একটি ইনডোর শপিং সেন্টারের নীচ দিয়ে চলে গেছে। এর ফলে নৌকাগুলো সিটি সেন্টারকে ঘিরে থাকা ৬ কি.মি নৌপথ দিয়ে চলতে পারছে।
খালটি রাইন নদীর সাথে যুক্ত হবে। এর ফলে মাছেদের বিচরণ এলাকাও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
পুরো শহর এই অনন্য মুহূর্তটি উদযাপন করছে। খালটি খুলে দেয়ার পরে অনেকেই এর পানিতে প্রমোদতরী ভাসিয়েছেন। কিছু মানুষকে সাঁতার কাটতেও দেখা গেছে।
করোনার কারণে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আয়োজন করা উদবোধনী অনুষ্ঠানে পৌরসভার স্টেশন এলাকার প্রধান এলকো এরেনবার্গ বলেন, “ ইউট্রেচডের বাসিন্দারা ও বাইরের অনেক মানুষ এই খালটিকে ভরাট করাকে সবসময়ই একটি বড় ভুল হিশেবে আখ্যায়িত করে আসছিলেন। এখন কয়েক বছরের কাজের পর আবার এটিকে ফিরিয়ে আনাটা সেই ভুলকে ভালো কিছুতে পরিণত করবে। শহরের ভিতরের অংশটি আবারো জল-সবুজ বেষ্টিত হয়ে উঠবে।“
তিনি আরো বলেন, “ পথচারী, সাইকেল আরোহী ও গণপরিবহন বিশুদ্ধ বাতাস ও দীর্ঘায়ুর জন্য বেশি ভূমিকা রাখে। অথচ এদের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি অনেক বেশি জায়গা দখল করে রাখে। ইউট্রেচটে আমরা ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের রাস্তার চেয়ে জল ও সবুজকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি।”
এরেনবাগ খালটি উন্মুক্ত ঘোষণা করার সময় একে কয়েক যুগের কাজের ‘মহৎ সমাপ্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ইউট্রেচট সেন্ট্রাল মিউজিয়ামের নগর ইতিহাসের কিউরেটর রেনে ডি কাম বলেন, “জলপথটিকে কংক্রিটের রাস্তায় পরিণত করার ভাবনাটা বেশ লোভনীয় ছিল। আমরা ভেবেছিলাম , একে কংক্রিটে ভরাট করে ফেললেই তো যানজটের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। নেদারল্যান্ডের কেনাকেটার কেন্দ্রটি খুব সহজেই গাড়িতে করে পৌঁছানো যাবে। আসলে এই ভাবনাটি ভুল ছিল।”
২০১৭ সালে শহরটিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাইসাইকেল পার্ক নির্মাণ করা হয়। এই পারকিং স্পেসটিতে বারো হাজার ৫০০ সাইকেল রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। শহরের সিটি সেন্টারের ভবনগুলির ছাদে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণির আবাসস্থল বানানো হয়েছে। জীববৈচিত্র রক্ষা ও বিশুদ্ধ বাতাসের প্রতি আগ্রহ থেকেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মহাপরিকল্পনার অংশ হিশেবে জোকারপার্ক নামের কেন্দ্রীয় উদ্যানটিকেও এর ১৮৩০ সালের মূল নকশায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।