পুরান ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত এলাকায় এক সাংবাদিকের লাইভের মাঝে ঢুকে পড়ে লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন তোলা পথশিশু মারুফ শেষ পর্যন্ত ফিরে পেয়েছে মায়ের কোল।
নিজ বাড়িতে ফেরার পর তাকে ভর্তি করা হয়েছে স্কুলে। মাদকের নেশা থেকে মুক্ত মারুফ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে বলে জানিয়েছেন তার স্বজন।
পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকা থেকে গত ২৪ এপ্রিল মারুফকে উদ্ধার করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। পরে শিশুটিকে অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
এরপর ১৮ মে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মারুফকে নিয়ে যান তার মা ও মামা। তারা জানান, চার বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল মারুফ।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত এলাকা থেকে ১৯ এপ্রিল দুপুরে ফেসবুকে লাইভ করেন সময়ের কণ্ঠস্বর নামের একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রধান প্রতিবেদক পলাশ মল্লিক।
তার কথা বলা প্রায় শেষের দিকে ক্যামেরার ফ্রেমে ঢুকে পড়ে পথশিশু মারুফ। সে বলে ওঠে, ‘এই যে লকডাউন দিছে, মানুষ খাবে কী? সামনে ঈদ। এই যে মাননীয় মন্ত্রী একটা লকডাউন দিছে, এটা ভুয়া। থ্যাঙ্কু।’
সাংবাদিক পলাশ মল্লিকের লাইভের মাঝে ঢুকে লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেসবুকে ভাইরাল হয় মারুফপরদিন মারুফের চোখে জখমসহ একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। ওই ছবি শেয়ার করে অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারকারী অভিযোগ তোলেন, লকডাউন নিয়ে সরকারি অবস্থানের বিরোধিতা করার কারণেই তাকে পুলিশ বা ছাত্রলীগ কর্মীরা মারধর করেছে।
লাইভের মাঝখানে ঢুকে পড়া মারুফ (বাঁয়ে) এবং তার জখম চোখের ভাইরাল ছবিতবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মারুফের সঙ্গে তার এলাকার পথশিশুদের মারামারিতেই জখমের ঘটনাটি ঘটে। সাংবাদিক পলাশের লাইভের পরদিন এক ব্যক্তি শিশুটির সঙ্গে আদালত এলাকায় একটি সেলফি তোলেন। সেই সেলফি থেকে শিশুটির ছবিটি কেটে নিয়ে ‘মনগড়া’ অভিযোগ তুলে ভাইরাল করা হয় ফেসবুকে।
আরও পড়ুন: লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন তোলা শিশুর চোখে জখম কেন
মারুফকে পরে উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। এরপর শিশুটিকে আদালতের আদেশের ভিত্তিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মিরপুরের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়। আশ্রয়কেন্দ্রে মারুফ কেমন আছে তা নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজবাংলা।
আরও পড়ুন: ভাইরাল সেই পথশিশু মারুফ এখন হাসছে, খেলছে
মারুফের সবশেষ অবস্থা জানতে গোদনাইল আশ্রয়কেন্দ্রে গত সপ্তাহে আবারও যোগাযোগ করলে কর্তৃপক্ষ জানায়, শিশুটিকে তার স্বজনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সে এখন আছে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার সাগরিয়ার জো খালী গ্রামে নিজ বাড়িতে।
মারুফকে রাখা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল আশ্রয়কেন্দ্রেএরপর স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয় নিউজবাংলা। মারুফের মামা জানান, তার বোনের সঙ্গে ঢাকায় এসে বছর চারেক আগে হারিয়ে গিয়েছিল শিশুটি। এরপর সম্প্রতি গণমাধ্যমে ছবি দেখে মারুফকে শনাক্ত করেন তারা।
স্বজনরা জানান, নারায়ণগঞ্জের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে এক মাসের মতো চিকিৎসায় মারুফ তার নেশার জীবন থেকে অনেকটাই বের হয়ে আসতে পেরেছে। এখন তাকে গ্রামের একটি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সে ক্লাসে যাবে।
মারুফের শিকড় যেখানে
মারুফের বাবার নাম আলমগীর হোসেন। মায়ের নাম মহিমা খাতুন। মহিমা চট্টগ্রামে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। স্বামী আলমগীর দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে মারুফ বড়।
মারুফের মামা এনায়েত হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, ২০১৭ সালে মারুফ ও তার মা তার বাড়িতে থাকত। মারুফের মা একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। একদিন মারুফের বাবা আলমগীর এসে তাকে ঢাকা নিয়ে যান। আর ঢাকায় যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে হারিয়ে যায় শিশুটি।
এনায়েত হোসেন বলেন, ‘আমরা তো অসহায়ের মতো আছিলাম। চাইর বছর ধইরা ভাগিনারে হারাইয়া ওর মায় অনেক কাঁনছে। আমরা কখনও ভাবি নাই মারুফরে ফিরা পামু। যারা মারুফরে ফিরা পাইতে সাহায্য করছে আল্লাহ তাগো মঙ্গল করুক।’
আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মায়ের কাছে হস্তান্তরের পর মারুফতিনি জানান, কঠোর লকডাউনের কয়েক দিন আগে সাগরিয়ার জো খালী গ্রামের একটি প্রাইমারি স্কুলে মারুফকে ভর্তি করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মারুফ স্কুলে যাবে। বর্তমানে বাড়িতে আছে।
আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মারুফকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়ার সময় সঙ্গে ছিলেন পারভেজ হাসান নামে এক স্বেচ্ছাসেবী। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় মারুফের পরিচয় পেতে অনেকে চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাইনি। তাই আমাদের সংগঠনের ফেসবুক পেজে মারুফের বিষয়ে পোস্ট দেয়া হয়। ভেবেছিলাম ঘটনাটি এখানেই হয়তো শেষ। পরে নিউজবাংলার সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারি মারুফকে নারায়ণগঞ্জে নেয়া হয়েছে। সেখানে ভালো আছে মারুফ।
‘এরপর হঠাৎ ১৫ মে আমার নম্বরে একটি ফোন আসে। ফোনটি করেছিলেন মারুফের মামা। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। তাদের জানাই মারুফ নারায়ণগঞ্জের আশ্রয়কেন্দ্র আছে। এরপর সেখান থেকে ১৮ মে থেকে মারুফকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।’
আশ্রয়কেন্দ্রে অনেক পাল্টেছে মারুফ
গোদনাইল আশ্রয়কেন্দ্রের উপপরিচালক কামরুন নাহার আরজু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মারুফ নামের শিশুটিকে তার মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যেহেতু তার পরিচয় শনাক্ত করা গেছে, তাই তাকে তার মায়ের জিম্মায় দেয়া হয়েছে। মারুফ তার মায়ের সঙ্গে বাড়িতে চলে গেছে।’
আশ্রয়কেন্দ্রের উপপরিচালক কামরুন নাহার আরজুর সঙ্গে মারুফবাবা-মায়ের শাসন, ভালোবাসা থেকে দূরে থাকা মারুফ পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে একপর্যায়ে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিল। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণও ছিল না তার।
আরজু বলেন, ‘মারুফ এখানে যে কয়দিন ছিল, তাতে তার মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। এখানে অন্য শিশুদের মতো খাবার খেয়েছে, পড়াশোনা ও খেলাধুলা করেছে।’
আশ্রয়কেন্দ্রে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা মারুফআশ্রয়কেন্দ্রের জমাদার নুর ইসলাম বলেন, ‘যাওয়ার সময় মারুফকে তার সহপাঠীরা ঘিরে ধরে। অল্প কিছুদিন হলেও মারুফ সবার সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব করেছে। তাই মারুফ চলে যাওয়ার সময় আশ্রয়কেন্দ্রের অনেক শিশুই তাকে বিদায় দিতে গেটের সামনে ছিল। আমাদের কাছেও অনেক ভালো লেগেছে ছেলেটি তার মায়ের কাছে ফিরে গেছে।’
তিনি জানান, মারুফ যখন আশ্রয়কেন্দ্রে আসে, তখন ওর পোশাক ও শারীরিক অবস্থা যেমন ছিল, ফিরে যাওয়ার সময় তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়েছে শিশুটির।