পুরান ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত এলাকায় এক সাংবাদিকের লাইভের মাঝে ঢুকে পড়ে লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন তোলা পথশিশু মারুফ এখন আছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল আশ্রয়কেন্দ্রে।
পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকা থেকে গত ২৪ এপ্রিল মারুফকে উদ্ধার করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। পরে শিশুটিকে অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
আশ্রয়কেন্দ্রে মারুফ কেমন আছে, তাকে পুনর্বাসনে কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিক- তা জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন অধিদপ্তর ও আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তারা।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত এলাকা থেকে ১৯ এপ্রিল দুপুরে ফেসবুকে লাইভ করেন সময়ের কণ্ঠস্বর নামের একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রধান প্রতিবেদক পলাশ মল্লিক।
তার কথা বলা প্রায় শেষের দিকে ক্যামেরার ফ্রেমে ঢুকে পড়ে পথশিশু মারুফ। সে বলে ওঠে, ‘এই যে লকডাউন দিছে, মানুষ খাবে কী? সামনে ঈদ। এই যে মাননীয় মন্ত্রী একটা লকডাউন দিছে, এটা ভুয়া। থ্যাঙ্কু।’
পরদিন মারুফের চোখে জখমসহ একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। ওই ছবি শেয়ার করে অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারকারী অভিযোগ তোলেন, লকডাউন নিয়ে সরকারি অবস্থানের বিরোধিতা করার কারণেই তাকে পুলিশ বা ছাত্রলীগ কর্মীরা মারধর করেছে।
তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মারুফের সঙ্গে তার এলাকার পথশিশুদের মারামারিতেই জখমের ঘটনাটি ঘটে। সাংবাদিক পলাশের লাইভের পরদিন এক ব্যক্তি শিশুটির সঙ্গে আদালত এলাকায় একটি সেলফি তোলেন। সেই সেলফি থেকে শিশুটির ছবিটি কেটে নিয়ে ‘মনগড়া’ অভিযোগ তুলে ভাইরাল করা হয় ফেসবুকে।
আরও পড়ুন: লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন তোলা শিশুর চোখে জখম কেন
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়া মারুফকে পরে উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এরপর শিশুটিকে আদালতের আদেশের ভিত্তিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মিরপুরের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখান থেকে গত সপ্তাহে তাকে পাঠানো হয় নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল আশ্রয়কেন্দ্রে।
মারুফকে রাখা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের গোদানাইল আশ্রয়কেন্দ্রেএই আশ্রয়কেন্দ্রের উপপরিচালক কামরুন নাহার আরজু সোমবার নিউজবাংলাকে জানান, অন্য শিশুদের মতোই মারুফকে খাবার, পড়াশোনা ও খেলাধুলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
কামরুন নাহার বলেন, ‘এই কেন্দ্রে থাকা ২০৯ শিশুর মতোই মারুফ সকালে ঘুম থেকে উঠে ইসলামি শিক্ষা (আরবি) পড়ছে। এরপরে সেখান থেকে ফিরে নাস্তা করে তার নির্ধারিত হাউসে থাকছে। সারাদিন খেলাধুলা, পুকুরে সাতার কাঁটা ও আশ্রয়কেন্দ্রের সহপাঠীদের সঙ্গে সময় পার করছে শিশুটি।’
করোনাভাইরাসের কারণে আশ্রয়কেন্দ্রের স্কুল এখন বন্ধ। কামরুন নাহার জানান, কেন্দ্রে যে নিয়ম রয়েছে সেটি মেনেই শিশুরা ভেতরে চলাফেরা করছে। মারুফও এখানে আসার পর নিয়ম মানছে।
কামরুন নাহার বলেন, ‘ভবঘুরে শিশুদের এখানে রাখা হয়। বিভিন্ন সরকারি মাধ্যমে তারা এখানে আসে। এই কেন্দ্রে তাদের শিক্ষার পাশাপাশি পরিচর্যা করা হয়। আমরা শিশুদের পরিচয় শনাক্ত করার চেষ্টা করি। কারও পরিচয় শনাক্ত করা গেলে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।’
এ আশ্রয়কেন্দ্রে দুটি গেটে ১০ জন নিরাপত্তাকর্মী দিন-রাত পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন।
মো. আশিক নামের এক নিরাপত্তাকর্মী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফেসবুকে মারুফকে প্রথম দেখেছি। তবে কখনও সে এখানে আসবে ভাবিনি। এখানে আসার পর মারুফের সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে।
‘সোমবার দুপুরেও দেখেছি মারুফ ভেতরে এক সহপাঠীর কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটছে। সকালে তাকে খেলতে দেখেছি। এখানে আসার পর তাকে নতুন পোশাক দেয়া হয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে।’
সাংবাদিক পলাশ মল্লিকের লাইভের মাঝে ঢুকে লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেসবুকে ভাইরাল হয় মারুফসমাজসেবা অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের উপপরিচালক আসাদুজ্জামান সরদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঢাকা থেকে মারুফকে এ কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। এখানে থাকা অন্য শিশুদের মতো তাকেও যত্ন করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি এখানে তার মানসিক পরিবর্তন পরিবর্তন ঘটবে।’
অন্যদিকে, ঢাকা জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক রুকনুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে সমাজসেবা আশ্রয়নের আওতায় প্রতিটি শিশু খুব যত্নে থাকে। কারণ যাদের আশ্রয় দেয়া হয়, তারা স্বাভাবিক শিশু নয়, এমনকি স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের পাওয়া যায় না। তাদেরকে আর ১০টা শিশুর মতো গড়ে তুলতে সমাজসেবার লোকজনের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই।
‘শিশু মারুফকেও বাড়তি যত্নের মধ্যে রাখা হয়েছে। তা ছাড়া তাকে যেন মাদকের নেশা আর তাড়া না করে বেড়ায়, সে জন্য খেলাধুলার পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চার অনুশীলন করানো হচ্ছে।’