জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের গেরুয়া গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শুক্রবার রাতে শিক্ষার্থীদের সংঘাতের পর এখনও উত্তপ্ত ক্যাম্পাস। সেই রাতে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫০ জন। অভিযোগ উঠেছে, গ্রামের মসজিদের মাইক ব্যবহার করে গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা হয়।
শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীর মুখোমুখি অবস্থানের কারণ হিসেবে সামনে এসেছে কয়েক দিন আগে আয়োজিত একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। বলা হচ্ছে, ওই টুর্নামেন্টের একটি ম্যাচকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের বিরোধের শুরু, যা শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সহিংসতায়।
তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসের আশপাশে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একটি অংশের আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে ইন্ধন দিয়েছে। ঘটনার দিন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজকদের এক জনকে জিম্মি করে চাঁদা দাবির অভিযোগও উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও পাশের গেরুয়া গ্রামে টানা দুই দিন অনুসন্ধান চালিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। গ্রামবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দাবি, সংঘর্ষের দুই দিন আগে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে বিরোধের বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানকে জানানো হয়েছিল। পুলিশও জানত বিষয়টি। দুই পক্ষের সমঝোতার জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যায়।
ঘটনা নিয়ে যা বলছেন গ্রামবাসী
গেরুয়া বাজারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক এলাকায় এখনও রয়েছে পুলিশের কড়া পাহারা, থমথমে পুরো এলাকা।
গ্রামবাসী জানান, কিছুদিন আগে স্থানীয় বাতিঘর ক্লাব আয়োজন করে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। সেখানে আশপাশের গ্রামের তরুণেরা আলাদা আলাদা টিম করে অংশ নেন। গেরুয়া গ্রামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৫০০ শিক্ষার্থী মেস ভাড়া নিয়ে থাকেন, ওই টুর্নামেন্টে গেরুয়া গ্রামের জাবি শিক্ষার্থীদেরও দুটি টিম ছিল।
গেরুয়া বাজারের সব দোকান এখনও বন্ধ, রয়েছে পুলিশের পাহারানিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, ১১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ক্রিকেট টুর্নামেন্টে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা অ্যালেক্সের (পিয়াস ইজারাদার) দলের প্রতিপক্ষ ছিল পাশের জামসিং গ্রামের একটি দল। ৪৪তম আবর্তনের শিক্ষার্থী অ্যালেক্স বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।
ক্রিকেট খেলার সময় স্লেজিং করাকে কেন্দ্র করে বাগ্বিতণ্ডা হয় দুই টিমের খেলোয়াড়দের। একপর্যায়ে জামসিং দলের খেলোয়াড়দের হাতে মার খান অ্যালেক্স ও আরেক ছাত্র।
এ ঘটনার পর অ্যালেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জাবি ছাত্রলীগের (মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি) সাংগঠনিক সম্পাদক অভিষেক মণ্ডলের (৪১তম আবর্তন) নেতৃত্বে অন্তত ৪০ জন ছাত্রকে নিয়ে ফিরে আসেন গেরুয়া গ্রামে। টুর্নামেন্টের আয়োজক কমিটি জামসিং গ্রামের তরুণদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, এমন অভিযোগ তুলে বাতিঘর ক্লাবে ভাঙচুর চালান তারা। এছাড়া পুরো বাজারের সব দোকান বন্ধ করে দেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা।
ক্রিকেট খেলায় বিরোধের জেরে ভাঙচুর করা হয় গেরুয়ার বাতিঘর ক্লাবওই সময়ের বাজার এলাকার একটি দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছে নিউজবাংলা। এতে দেখা যায় ১১ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টা ৩৩ মিনিটের দিকে বেশ কিছু যুবক মোটরসাইকেলে করে এসে ব্যবসায়ীদের কিছু বলার পর তারা সবাই দোকানের শাটার নামিয়ে দিচ্ছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এর আট দিন পর গত শুক্রবার বিকেলে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজক কমিটির এক সদস্য নজরুল ইসলাম কাজুকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান। গেরুয়া বাজারের যে বাসায় ছাত্রলীগ নেতা অভিষেক ও অ্যালেক্সরা থাকেন সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় কাজুকে।
এরপর কাজুকে উদ্ধার করতে ওই বাসা ঘিরে ফেলেন গ্রামের বেশ কয়েকজন। অভিষেক ও আরও কয়েকজন এ সময় কৌশলে পালিয়ে গেলেও গ্রামবাসীর বেধড়ক পিটুনির শিকার হন অ্যালেক্স, জুবায়েরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১২ জন ছাত্র। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের চারটিসহ মোট পাঁচটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময়েই এলাকার চারটি মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় ‘গ্রামে ডাকাত ঢুকেছে’। শুরু হয় গ্রামবাসী-ছাত্রদের সংঘর্ষ।
যাকে ‘তুলে আনা’র ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত বড় সংঘর্ষ, ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজক কমিটির সেই সদস্য ও স্থানীয় ইন্টারনেট ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম কাজুর সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
কাজু বলেন, ‘১১ তারিখের ঝামেলার জন্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমাকে দোষারোপ করেন। তারা বলেন আমার জন্য নাকি সেদিন জামসিংয়ের ছেলেরা পালিয়ে যেতে পেরেছেন। তারা (ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী) আমাদের ক্লাবের সদস্যদের চাপ দিতে থাকেন তাদের ধরে এনে দেবার জন্য। তারা মেরে প্রতিশোধ নেবেন।’
কাজু বলেন, ‘আমরা তো সেদিন মারামারি ঠেকাতে গিয়েছিলাম, সেখানে আমাদের কী দোষ? রাতে আমাদের বাসায় এসে মারার হুমকি দেয়। বিষয়টা এলাকার মুরব্বিদের জানালে তাদের পরামর্শে আমরা ক্লাবের ছয় জন সদস্য কয়েক দিন গ্রামের বাইরে ছিলাম। তখন তারা আমাদের বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়েছে। এরপর ঢাকা উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম ও অন্য মুরব্বিরা ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে বসে মীমাংসার চেষ্ট করেন, কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।’
নজরুল ইসলাম কাজু অভিযোগ করেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) তার বন্ধু মারুফকে ডেকে নিয়ে যান অ্যালেক্স। এরপর মারুফকে প্রস্তাব দেয়া হয়, দুই লাখ টাকা দিলে ঝামেলা মিটমাট করা হবে।
এই মাঠে আয়োজিত ক্রিকেট টুর্নামেন্ট কেন্দ্র করে বিরোধের শুরুবিরোধ মীমাংসায় যুক্ত হন অনেকে
ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ তুলে কাজু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মারুফের কাছ থেকে শোনার পর টাকা চাওয়ার বিষয়টা আমরা মনিরুল ইসলাম (ঢাকা উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক) ও স্থানীয় মেম্বার হাসান সরদারকে জানাই। তারা আমাদের সংসদ সদস্য ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানের কাছে নিয়ে যান। টাকা চাওয়াসহ পুরো বিষয়টি আমরা মৌখিকভাবে প্রতিমন্ত্রীকে জানিয়েছি।’
আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক হারুন অর রশিদকেও বিষয়টি অবহিত করা হয় বলে দাবি করেন কাজু।
এর পরের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে চারটি মোটরসাইকেলে করে ছাত্রলীগের আট জন আমার বাসায় এসে বলে আমার সাথে কথা আছে, তাদের সাথে যেতে হবে। তাদের মধ্যে রমিম, মুরাদ, রিফাত, শুভ আমার পূর্ব পরিচিত। আমি আমার মোটরসাইকেলে চড়ে তাদের সাথে যাই। তারা আমাকে অভিষেকের রুমে দিয়ে আসে।’
কাজু বলেন, ‘সেখানে অ্যালেক্স আর অভিষেক ছিল। অভিষেক একটি পিস্তল আর চাপাতি দেখিয়ে আমাকে বলে দুই লাখ টাকা দে, নইলে জানে মেরে ফেলব। এই বলেই আমাকে চড় থাপ্পর মারতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরেই গ্রামবাসী তাদের ঘিরে ফেলে মারধর করে।’
জিম্মি করে চাঁদা দাবির অভিযোগ তোলা নজরুল ইসলাম কাজুকাজুর বন্ধু মারুফের সঙ্গেও কথা বলেছে নিউজবাংলা। তিনি বলেন, ‘১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে অ্যালেক্স আমাকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে বলে। পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায় শহীদ রফিক-জব্বার হলের সামনে তার সাথে দেখা করি। সে আমাকে প্রস্তাব দেয় ৫০ হাজার টাকা দিলে শুধু আমার বিষয়টা মিউচ্যুয়াল করবে। তবে কমিটির সবার সাথে মিউচ্যুয়াল করতে হলে ওই দিন বিকেল ৫টার মধ্যে ২ লাখ টাকা দিতে হবে। তারপর আমি এসে গ্রামের সবাইকে বিষয়টা জানাই।’
চাঁদা দাবির অভিযোগের সত্যতা জানতে ঢাকা উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম, গেরুয়ার স্থানীয় মেম্বর হাসান সরদার ও আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক হারুন অর রশিদের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
মনিরুল ও হাসান স্বীকার করেন, জাবি ছাত্রলীগ নেতাদের চাঁদা দাবির বিষয়টি মারুফ ও কাজু তাদের জানিয়েছিলেন। এরপর প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানের পরামর্শে তারা থানায় গেলেও লিখিত কোনো অভিযোগ না করে চার জনের বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ করেন।
আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক হারুন অর রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা (মারুফ ও কাজু) ১৭ তারিখ এসে ক্রিকেট খেলা নিয়ে ঝামেলা আর জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রদের হুমকির বিষয়ে মৌখিক অভিযোগ জানিয়েছিলেন, তবে তখন চাঁদার বিষয়টি বলেননি। ১৯ তারিখ সন্ধ্যার আগে একজন ফোন করে আমাকে জানান তাকে আটকে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে, সেই নিয়ে গণ্ডগোল চলছে।’
গেরুয়ার এই বাসায় অ্যালেক্স-অভিষেকদের অবরুদ্ধ করে গ্রামবাসীপ্রতিমন্ত্রীর দাবি, আগে কিছুই জানতেন না
গ্রামবাসীসহ বিভিন্ন পক্ষ গেরুয়ার বিরোধের বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানকে আগেই জানানোর দাবি করলেও প্রতিমন্ত্রী বলছেন, সংঘর্ষের পর বিষয়টি তিনি প্রথম জেনেছেন।
রোববার নিউজবাংলাকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘শুক্রবার বিকেলে গণ্ডগোলের খবর পেয়ে আমি গ্রামের প্রতিনিধিদের কাছে ফোন করে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাই। তারা আমাকে জানান, ক্রিকেট খেলা নিয়ে ছাত্র আর গ্রামাবাসীর মধ্যে গণ্ডগোল বেধেছে। ছাত্ররা গ্রামের এক ছেলেকে তুলে এনে মেরেছে, তাই তারা পাল্টা হামলা করে ওই ছেলেকে উদ্ধার করে। এর আগে আমি কিছুই জানতাম না। কোনো অভিযোগ নিয়ে গ্রামবাসী বা তাদের পক্ষ থেকে কেউ আমার কাছে আসেনি।’
প্রতিমন্ত্রী আগে থেকে বিষয়টি জানার তথ্য অস্বীকার করায় রোববার বিকেলে ঢাকা উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম ও গেরুয়ার মেম্বর হাসান সরদারের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করে নিউজবাংলা।
এ সময় মনিরুল বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে আমি যাইনি, তবে হাসান মেম্বর ও গ্রামের লোকেরা গিয়েছিলেন।’
প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি নাকচ করেছেন জানানোর পর মনিরুল বলেন, ‘মন্ত্রী সাহেব যদি বলে থাকেন যে কেউ যায় নাই, তাহলে সেইটাই সঠিক। আপনারা সেটাই লিখে দেন, তবে আমি যতদূর জানি তারা (গ্রামবাসী) মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে গত বুধবার দেখা করেছেন।’
অন্যদিকে মেম্বর হাসান সরদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেদিন মনিরও আমাদের সাথে গিয়েছিল। সে এখন অস্বীকার করে কীভাবে! আমরা তো তার মাধ্যমেই মন্ত্রী সাহেবের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করলাম।’
হাসান বলেন, ‘আমরা বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মন্ত্রীর সাভারের বাসায় যাই। তখন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর আরও চার-পাঁচ জনসহ মনির আসে। এরপর বিকেল ৩টায় মন্ত্রীর সাথে আমাদের কথা হয়। আমরা তাকে সব খুলে বলে এলাম। মন্ত্রী সাহেব কেন অস্বীকার করছেন জানি না।’
বিরোধের বিষয়ে জানত বিশ্ববিদ্যালয়ও
বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ফিরোজ উল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্রিকেট নিয়ে গণ্ডগোলের পরপরই আমি ঘটনাটা শুনেছিলাম। তখন আমি সাভার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রমজান আহমেদকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, সে যেন মিজানুর রহমান মিজানকে (বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি) সাথে নিয়ে বিষয়টা সমাধান করে দেয়। পরে অবশ্য কোনো আপডেট পাইনি।
২ লাখ টাকা চাঁদা দাবির বিষয়টি জানা নেই বলে দাবি করেন প্রক্টর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ফিরোজ উল হাসানএ বিষয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর রমজান আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রক্টর স্যারের ফোন পাওয়ার পর আমি কয়েকবার অভিষেক-অ্যালেক্সদের সাথে কথা বলেছি। তাদের দাবি ছিল, খেলার সময় জামসিং গ্রামের যে ছেলেরা মেরেছিল তাদের সামনে এনে দিতে হবে। ওই ছেলেদের আনতে পারি নাই, তাই সমাধানও হয় নাই।’
অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা কয়েকবার অভিষেকদের কাছে অনুরোধ করেছি বিষয়টা মীমাংসা করার জন্য, কিন্তু তারা বলেছিল, বিষয়টা তারা পার্সোনালি নিয়েছে।’
একই ধরনের তথ্য দিয়ে গেরুয়ার মেম্বার হাসান সরদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি অ্যালেক্সকে ফোন দিয়ে মীমাংসা করতে বলায় সে আমাকে বলেছিল, আপনারা মুরব্বিরা এটা থেকে দূরে থাকেন। এটা আমরা বুঝব।’
অ্যালেক্স-অভিষেক যা বলছেন
মারুফের সঙ্গে দেখা হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ছাত্রলীগ নেতা অ্যালেক্স। তবে তার দাবি, মারুফ তার এক বন্ধুর বন্ধু হওয়ায় মারুফের মাধ্যমে সমঝোতার প্রস্তাব দিতে ডাকা হয়েছিল।
অ্যালেক্স নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বারবার চেষ্টা করেও তাদের সাথে বসতে পারছিলাম না। সমঝোতার জন্য কোনো ধরনের টাকার কথা হয়নি।’
১১ ফেব্রুয়ারি গেরুয়ায় ক্লাব ঘরে ভাঙচুর ও বাজারের দোকান বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যালেক্স বলেন, ‘ক্যাম্পাসের ছেলেরা মার খেয়েছে, সেই উত্তেজনা থেকে ভাঙচুর হয়েছে। সেই একই উত্তেজনা থেকে দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হলেও আধ ঘণ্টা পর সেগুলো আমরা খুলে দেই।
কাজুকে তুলে এনে অস্ত্র প্রদর্শনের অভিযোগ অস্বীকার করে অ্যালেক্স বলেন, ‘তাকে তো তুলে আনা হয়নি, সে ক্যাম্পাসের হলে ইন্টারনেট ব্যবসা করে। তার সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক। আমাদের সাথে মীমাংসার জন্য তার পরিচিত ক্যাম্পাসের ছাত্ররাই আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিল। পরে আমরাই বরং অবাক হয়েছি কাজুকে আনার সাথে সাথেই অন্তত ৫০ জন লোক এসে আমাদের মারা শুরু করল। তুলে এনে জিম্মি করা হলে আমরা তাকে নিয়ে তাদের গ্রামে কেন রাখব, আমরা তো তাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে যেতাম।’
একইভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগ নেতা অভিষেক। তিনি বলেন, ‘এমন কিছুই ঘটেনি। আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ করতেই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’
গেরুয়ায় অ্যালেক্স-অভিষেকদের অবরুদ্ধ করার সময়ে ভাঙচুর করা মোটর সাইকেলকাজুকে উদ্ধারের সময় গ্রামবাসী সহিংস কেন
গ্রামের একাধিক বাসিন্দা নিউজবাংলাকে বলেছেন, তারা আন্দাজ করতে পারছিলেন ছাত্রলীগের ছেলেরা খেলার সময় মার খাওয়ার প্রতিশোধ নেবে। এর আগে ২০০৭ সালে বিরোধের জেরে কাশেম নামের এক যুবককে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ছাত্ররা। বেদম পিটানোর পর তিনি মারা যান। সেই মামলার এখনও বিচার হয়নি।
কাজুরও একই পরিণতি হতে পারে, এমন শঙ্কা ছিল গ্রামবাসীর।
এছাড়া, কথায় কথায় বাজার বন্ধ করে দেয়া, গ্রামের যেকোনো বিষয়ে ক্ষমতা দেখানো, স্থানীয়দের মারধর করাসহ চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে ছাত্রলীগের একটি অংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছে গ্রামবাসী।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মান্নান অভিযোগ করেন, তার তিনতলা বাড়ি নির্মাণের সময় গত বছর ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ নেতারা ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন।
কারা চাঁদা নিচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো ভবন মালিকই এদের নাম জানাতে চান না। আপনারা পারলে খুঁজে নেন।’
সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সম্পর্ক কেমন
ক্যাম্পাস ঘেঁষা গেরুয়া গ্রামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী থাকছেন। গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অনেক বাড়িতেই ভাড়াটিয়া হিসেবে আছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সাবেক শিক্ষার্থীও আছেন এই গ্রামে।
সংঘর্ষের পরেও গেরুয়া গ্রামে আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, গ্রামবাসীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আন্তরিক।
গ্রাম ছাড়েননি এমন একাধিক ছাত্র নিউজবাংলাকে জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার ঘটনার সময় তারা নিরাপত্তার জন্য নিজ থেকেই ঘরে অবরুদ্ধ ছিলেন। এমনকি কোনো কোনো বাড়ির মালিক সে সময় ছাত্রদের নিরাপত্তার বিষয়ে নজর রেখেছেন।
গ্রামবাসীও বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের কোনো ঝামেলা নেই। ছাত্রদের খুব সামান্য একটি অংশ প্রভাব বিস্তার করতে গ্রামে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করছে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ক্যাম্পাস ও জেলা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা নিউজবাংলাকে জানান, প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে জাবি ছাত্রলীগ ও ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের মধ্যে সব সময় স্নায়ুযুদ্ধ চলে। ক্যাম্পাস ঘেঁষা ও জাবি ছাত্রলীগের কারণে গেরুয়ার মতো গ্রামে জেলা ছাত্রলীগ প্রভাব রাখতে পারছে না।
ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীকে উসকে দিতে চেষ্টা করেন জেলা ছাত্রলীগ নেতারা, অন্যদিকে জেলার অনুসারীদের দমিয়ে রাখতে বাড়তি তৎপরতা দেখায় ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ।