২০১৬ সালে আমেরিকাতে আসার পর প্রবাসী ট্যাগ লেগে যাওয়ার প্রায় চার বছরের মাথায় দেশটির নাগরিকত্ব পেয়ে যাই। এরপর যে বিষয়টি প্রথম মাথায় আসে সেটি হলো, এখন আমিও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশটির সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারব।
২০২০ সালে নাগরিকত্ব পাওয়ায় এই বছর সুযোগটা পেয়ে গেলাম। বাংলাদেশে সরকার নির্বাচনের যে প্রস্তুতি, ভোটের লড়াই, তার ছিটেফোঁটাও নেই আমেরিকার নির্বাচনে। করোনা ভাইরাসের সংকটময় সময়ে সেটা আরও মলিন।
হাতে গোনা কয়েকটি প্রচার পর্ব আর বিতর্ক ছাড়া কিছুই চোখে পড়ার মতো ছিল না। নিউজ চ্যানেলের টক শোগুলোও ঢাকা পড়ে করোনা ভাইরাসে।বড় দুটো দল হিসেবে ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান বরাবরের মতো পেনসিলভিনিয়াতেও সরব। ছোট দল হিসেবে লিবার্টারিয়ান, গ্রিন এবং কনস্টিটিউশন পার্টি শুধু তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। প্রচারের অংশ হিসেবে কোনো মার্কা ব্যবহার করে না আমেরিকা।
পুরো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় অঙ্গরাজ্যগুলোর সার্বিক তত্ত্বাবধানে। প্রত্যেকটি রাজ্যের ব্যালট, প্রচারণার ধরন হয় আলাদা। কারণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছাড়াও প্রত্যাকটি স্টেটের কংগ্রেস, সিনেট এবং হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচনও একই ব্যালটে সেরে ফেলতে হয়।
বিস্তারিত বলার কারণ হলো, প্রতিটি দল তাদের প্রার্থীর প্রচারের জন্য রাজ্যর নিজস্ব নিয়ম মেনে চলে। প্রচারের মাধ্যম হিসেবে তারা বেছে নেয় ডাক বিভাগ। বাংলাদেশ ডাকবিভাগের চল হারিয়ে গেলেও আমেরিকার ডাক ব্যবস্থা খুবই মজবুত।
একবার ভোটার রেজিস্ট্রেশন করা হয়ে গেলে ডাকে একে একে আসতে থাকে লিফলেট। যেখান থেকে প্রার্থী সম্পর্কে ধারণা পান ভোটাররা। আমার বাসার মেইলবক্সে গত দেড় মাসে জমা হয়েছে প্রায় শ’খানেক লিফলেট।
বাংলাদেশে বড় হওয়ায় নির্বাচনি হাওয়া পেতাম অনেক আগে থেকেই। মিটিং, মিছিল, শ্লোগান, পোস্টার আর মার্কার গর্জনে আবহাওয়া থাকতো উত্তপ্ত। এখানে হতাশ হতে হলো। ভোটের আমেজ একেবারেই নেই।
আরেকটা নতুন জিনিস জানলাম, সেটা হলো অনুপস্থিতি ভোট। অসুস্থতার জন্য কোনো ভোটার যদি ভোটকেন্দ্রে না যেতে পারেন তাহলে সে নিজ বাসা থেকেই ভোট দিতে পারবেন। করোনা ভাইরাসের প্রকোপের জন্য এবার এই পন্থাটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই ভোটগুলোই যে পরবর্তীতে নির্ধারকের কাজ করবে সেটা কে জানত!
আমিও সেই পথেই হাঁটলাম। অ্যাবসেন্টি ব্যালটের জন্য অ্যাপ্লাই করার চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই মেইলবক্সে ব্যালট পেপার এসে হাজির। এরপর ইমেইল, মেইল আর মোবাইলের টেক্সট মেসেজে একের পর এক আসতে থাকে ব্যালট পেপার ফেরত দেয়ার রিমাইন্ডার।
শত ব্যস্ততায় ব্যালট পূরণ করতে ভুলে গেলেও রেহাই নেই। চট জলদি বাক্স ভরাট করে গোপন খামে ব্যালট ভরার পর সেটাকে আরেক দফায় আরেক খামে ভরে, স্বাক্ষর করে মেইলবক্সে ফেলার পরই মিলল স্বস্তি।
এখানেই শেষ না। ব্যালট পেপার ঠিক মতো নির্বাচন কমিশনে পৌঁছাল কিনা তা ট্র্যাক করার লিংকও মোবাইলে চলে আসল। ভোটের তখনও বাকি প্রায় দুই সপ্তাহ।
ভোটের দিন আমেজটা বাংলাদেশের মতো না হলেও দিনটা যে অন্যরকম সেটা বোঝা যাচ্ছিল। সবার চোখ টিভির পর্দায়। নির্বাচনের জন্য কোনো সাধারণ ছুটি নেই। তাই কাজ ফাঁকি দিয়ে শুধু টিভি দেখার অবকাশ নেই। তবে আমার অফিসের মিটিংগুলো সব বাতিল ঘোষণা করায় কিছুটা ফুর্তি তো ছিলই।
মনে করেছিলাম রাতের মধ্যেই ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি দিয়ে পরদিনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। সেখানে বাধ সাধে কয়েকটি রাজ্যের ভোট গণনা।
পেনসিলভিনিয়া, অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, উইসকনসিন আর নেভাডার ভোট সম্পূর্ণ গণনা তখনও বাকি। জো বাইডেন ক্ষমতাসীন ডনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকলেও এই পাঁচ রাজ্যের চারটিতে এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প।
সিএনএন, ফক্স আর এমএসএনবিসি চ্যানেলগুলোতে নজর রাখছিলাম সবশেষ ফলাফলের আশায়। বলা হচ্ছিল পেনসিলভিনিয়া স্টেটের ফিলাডেলফিয়া কাউন্টি এবং আশে পাশের এলাকার অসংখ্য ভোট গণনা বাকি। যা রাজ্যটি মোট ভোটের প্রায় ১৫ শতাংশ।
এর প্রায় সব গুলোই মেইলে আসা। সেই ১৫ ভাগ ভোট নির্ধারণ করতে পারে নির্বাচনের ভাগ্য। কারণ পেনসিলভিনিয়ার ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ২০। আমার বাসা ওই এলাকায় হওয়ায় কিছুটা দুশ্চিন্তা যে হয়নি তা বলব না। আবারও ট্র্যাকিং লিংক চেক করলাম। দেখলাম আমার ভোট ঠিকমতোই রেকর্ড হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত চারদিনের অপেক্ষা শেষে পেনসিলভিনিয়াকে উদ্ধার করেন জো বাইডেন। যা তার জন্ম স্থান হলেও ট্রাম্পের ঘাটি হিসেবে পরিচিত ছিল। বেশ বড় ব্যবধানে ট্রাম্পকে হারিয়ে দেশটির ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বাইডেন।
সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০ জানুয়ারি, ২০২১ শপথ নেবার কথা জো বাইডেন এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসের। ক্ষমতাধর দেশটির দায়িত্ব নিয়ে দেশটির সুশাসন, উন্নয়ন এবং বহির্বিশ্বের শান্তির জন্য তারা কতটা কাজ করেন- সেটাই এখন দেখার বিষয়।