বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ স্বপ্ন দেখেন বিদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করবেন। তাদের একটি বড় অংশের লক্ষ্য থাকে যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, জার্মানিও উচ্চশিক্ষার জন্য কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। তবে আমি এই লেখায় কিছু তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে চাই নরওয়ে নিয়ে।
উত্তর ইউরোপের দেশ নরওয়ে, আমরা সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে জেনেছি ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ হিসেবে, উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের ছাত্রী-ছাত্রদের কাছে তুলনামূলক কম জনপ্রিয় গন্তব্য। তবে বাংলাদেশ থেকে অনেকেই এদেশে পড়তে আসেন। বলতে গেলে সবাই আসেন, স্নাতকোত্তর বা মাস্টারস অথবা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে। লেখাপড়ার জন্য নরওয়েকে বেছে নেয়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সম্ভবত খরচ। নরওয়েতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখার জন্য টিউশন ফি দিতে হয় না। যদিও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এই সুবিধা বাতিলের বিষয়ে আলোচনা চলছে, নরওয়ের সরকার যেকোনো সময়ে আইন বদলে ফেলতেও পারে।
২০১৮ সালের হিসাবে নরওয়েতে এখন পর্যন্ত নয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এছাড়াও রয়েছে ইউনিভারসিটি কলেজ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। সাধারণত সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কলেজেই বিদেশি শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারবেন। বাংলাদেশের ছাত্রী-ছাত্রদের জন্য নরওয়ের সরকার স্নাতক বা ব্যাচেলর ডিগ্রিতে ভর্তির ক্ষেত্রে ভিসা দিতে চায় না- সাবেক আবেদনকারীদের অভিজ্ঞতা থেকে এমন তথ্য মিলেছে। তাই যারা নরওয়েতে পড়ালেখা করতে চান তাদের জন্য মাস্টারস বা পিএইচডি ডিগ্রিতে আবেদন করাই উপযুক্ত হবে।
ভর্তির যোগ্যতার তথ্য: বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষায় যেসব বিষয়ে পড়ানো হয় তার আলাদা তালিকা থাকে। আবেদনকারীকে খুঁজে বের করতে হবে কোন বিষয়টি ইংরেজিতে পড়ানো হয়। কারণ নরওয়ের ভাষা নরস্ক বা নরওয়েজিয়ান এবং এই ভাষাতেই বেশিরভাগ বিষয়ে পড়ালেখা হয়। ইংরেজিতে যে বিষয়গুলো পড়ানো হয় সেগুলোতে ভর্তির যোগ্যতা হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আইইএলটিএস বা গ্রহণযোগ্য ইংরেজি ভাষা দক্ষতার প্রমাণ জমা দিতে হয়। সাধারণত, ব্যাচেলরে সিজিপিএ ৩.৫ বা তার বেশি থাকলে ভর্তির সুযোগ বাড়ে।
নরওয়েতে সবচেয়ে বেশি সুযোগ এবং সুবিধা রয়েছে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য - কম্পিউটার সায়েন্স, পদার্থবিদ্যা, প্রকৌশলের বিভিন্ন বিষয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে পড়ালেখা ইত্যাদি। এছাড়া মেরিটাইম নিয়ে পড়ালেখার জন্যও এদের সুনাম আছে। সামাজিক বিজ্ঞান বা কলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য খুব বেশি সুযোগ নেই কারণ ভাষাগত সীমাবদ্ধতা। ইংরেজি সাহিত্য, নাটক এবং হাতেগোনা কিছু বিষয়ে বিদেশিদের জন্য ইংরেজিতে পড়ার সুযোগ মিলবে।
পিএইচডিতে ভর্তির প্রক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন। নরওয়েতে পিএইচডি-কে বেশিরভাগক্ষেত্রেই একটি ফুলটাইম জব বা পূর্ণকালীন চাকরি হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে পিএইচডি-র ভর্তির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাকরির মতো করে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে, আপনাকে সেখানে আবেদন করতে হবে এবং বিজ্ঞাপনের বিবরণ অনুযায়ী শর্ত পূরণ করে আপনি ভর্তি হবেন। সবচেয়ে লোভনীয় বিষয় হলো পিএইচডির শিক্ষার্থীরা এখানে চাকরিজীবীদের মতো পুরোদস্তুর বেতন পায়। আরেকটা তথ্য জানিয়ে রাখা ভালো, বাংলাদেশের ছাত্রী-ছাত্রদের জন্য নরওয়ের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বৃত্তি আপাতত চালু নেই শুধু একটা মোবিলিটি গ্র্যান্ট পেতে পারেন সেটাও নরওয়েজিয়ান ভাষাশিক্ষার জন্য। তবে নরওয়েতে আসতে চাইলে নরওয়েজিয়ান ভাষা শিখে আসতে পারলে খুবই সুবিধা পাবেন। কারণ শিক্ষার্থী ভিসায় এদেশে খণ্ডকালীন কাজ করার অনুমতি রয়েছে, সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা বা মাসে সর্বোচ্চ ৮০ ঘণ্টা।
নরওয়েতে পড়ালেখার জন্য আসতে চাইলে যা করণীয়:
প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বর সময়ে ভর্তি আবেদন গ্রহণ করা হয়। সুতরাং যারা আগ্রহী তাদেরকে অগাস্ট থেকেই প্রস্তুতি শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছি। প্রথমেই পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় এবং পড়ার বিষয়টি নির্বাচন করুন। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় বাছাই করতে পারেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে কোনো ফি দিতে হয় না। ভর্তির যোগ্যতা ভালো করে দেখে নিন, কি কি নথিপত্র দরকার সব একত্রিত করে স্ক্যান করে ফেলুন। আইইএলটিএস পরীক্ষা সেপ্টেম্বরের মধ্যে দিয়ে দিন বা ইংরেজি ভাষা দক্ষতার প্রমাণ নিশ্চিত করুন। ভর্তির আবেদন গ্রহণ শুরু হলেই যতদ্রুত সম্ভব আবেদন করে ফেলুন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে এমনিতেই আসন সীমিত থাকে এবং নরওয়েজিয়ান শিক্ষার্থীদের জন্যই বেশিরভাগ আসন সংরক্ষিত থাকে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তাই আসন সংখ্যা থাকে হাতেগোণা।
পরের বছর মার্চের দিকে ফল আসা শুরু হয়। মার্চ-এপ্রিল নাগাদ আপনি জেনে যাবেন আপনি ভর্তি হতে পারবেন কিনা। ভর্তির প্রস্তাব বা অ্যাডমিশন অফার পাওয়ার পর আপনাকে তা গ্রহণের জন্য সাত দিন সময় দেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আপনি ইতিবাচক উত্তর দিলে এরপর আপনাকে সাধারণত ১৫ দিনের মধ্যে আপনার এক বছরের চলার খরচ (বর্তমানে ১,২১,২২০ নরওয়েজিয়ান ক্রোনার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টাকা) বিশ্বিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিতে হবে। টাকা জমা হলে বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে অ্যাডমিশন লেটার পাঠাবে, সেটা প্রিন্ট করে আপনি ভিসার জন্য আবেদন করবেন। ভিসা পেলে টিকিটে কেটে চলে আসবেন নরওয়ে।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট: https://www.studyinnorway.no/ ফেইসবুক-এ তথ্য পেতে এই গ্রুপে যোগ দিতে পারেন: https://www.facebook.com/groups/hsanorway