কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৪তম আসরে অঁ সতেঁ রিগা বিভাগে প্রতিযোগিতা করছে বাংলাদেশের সিনেমা রেহানা মরিয়ম নূর। সিনেমাটির পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ।
উৎসব শুরু হয়েছে ৬ জুলাই, চলবে ১৭ জুলাই পর্যন্ত। ১৬ জুলাই ঘোষণা করা হবে অঁ সতেঁ রিগা বিভাগের পুরস্কার।
৭ জুলাই কানে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছে রেহানা মরিয়ম নূর সিনেমাটির। উৎসবে অতিথি হয়ে আছেন সিনেমাটির প্রযোজক, শিল্পী ও কলাকুশলী এবং পরিচালক।
ফরাসি সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর সম্প্রতি প্রকাশ করেছে নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের একটি সাক্ষাৎকার। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য এর অনুবাদ করেছেন ক্রিস্টিনা জয়ীতা মুন্সী।
কানের অফিশিয়াল সিলেকশনের অংশ হতে পেরে কেমন লাগছে? এবং দেশে এই খবরে কেমন সাড়া পেয়েছেন?
এখানে আসতে পারাটা অনেক সম্মানের এবং অনেক বেশি অনুপ্রেরণার। সিনেমা বানাতে গেলে অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়, একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হয়, পরিশ্রম করতে হয় আর অনেক সময় দিতে হয়। তাই যখন ভালো কোনো সংবাদ পাওয়া যায়, সেটা সত্যিই সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।
দেশের সবাই এ খবরে অনেক আপ্লুত হয়েছে। আমার চেয়ে এটা দেশের জন্য অনেক বড় অর্জন। এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলো, তাই এই খবরটা সবার জন্য অনেক বেশি আনন্দের, সামনে আরও সিনেমা বানিয়ে যেতে আস্থা পাব আমরা।
বাঁ থেকে- সাদ, জেরেমি চুয়া ও রাজিব মহাজন। ছবি: সংগৃহীত
আপনার মতো একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালকের জন্য এই সিনেমার খরচ জোগাড় করাটা কতটা কঠিন ছিল?
অন্যান্য সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির চেয়ে আমাদের দেশে সিনেমা নির্মাণের চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। কিন্তু এই সিনেমার জন্য টাকা জোগাড় করতে আমাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে কাজ করতেই পছন্দ করি, আগের সিনেমাতেও তাই করেছি। সিনেমার সিঙ্গাপুরের প্রযোজক জেরেমি চুয়াকে প্রযোজক হিসেবে পেয়েও আমি ভাগ্যবান, তিনি গল্প লেখাতেও অনেক সাহায্য করেছেন।
সিনেমার প্রধান অভিনেত্রী তার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন সিনেমায়, আমাদের যা যা প্রয়োজন ছিল, তার সবই আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি।
আমার সিনেমাটোগ্রাফারকে পুরো এক বছর জিম করতে হয়েছে। কারণ, আমি বলেছিলাম সিনেমার প্রোডাকশনে তার অনেক কষ্ট হবে। হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরা আর লং শটগুলো নেয়ার জন্য তাকে ফিট থাকতে হবে। আমার টিম আমাকে যা কিছু দিয়ে সাহায্য করেছে, এগুলো তার অল্প কিছু উদাহরণমাত্র।
আপনার সিনেমা আকর্ষণীয়ভাবে চরিত্রদের নিয়ে খেলা করে। এ চরিত্রের খোঁজ কীভাবে শুরু?
আমি বড় তিন বোনের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। তারা খুব সাহসী, সুন্দর, দৃঢ় চরিত্রের এবং বুদ্ধিমান। তারা সব সময়ই আমাদের পরিবারে কর্তৃত্ব করেছে এবং আমার ওপরেও তার অনেক প্রভাব পড়েছে। তাদের আমি খুবই কাছ থেকে দেখেছি, একজন মেয়ে থেকে বোন তারপর একজন মা থেকে কর্মজীবী হওয়া; এই পরিবর্তনগুলো বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করেছে।
এই পুরো প্রজেক্টটা শুরু হয়েছিল আমার মাথায় চলতে থাকা প্রচণ্ড জেদী এক নারীর ভাবনা থেকে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম সে কী রকম মানুষ, তাকে জানতে আমি কতটা চেষ্টা করতে পারি।
ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারে কথা বলছেন আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। ছবি: সংগৃহীত
‘মি টু’ মুভমেন্টের দিক থেকে চিন্তা করলে রেহানা অবশ্যই জয়ী নয়। একটা জটিল, নৈতিকভাবে দোদুল্যমান একটা চরিত্র তৈরি করা কি আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
মানবিক চরিত্রের একটা অনুসন্ধান আমার সিনেমা। আমি কোনো রাজনৈতিক চিন্তা থেকে এটা লিখিনি। সিনেমায় অবশ্যই একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে। কিন্তু আমি নিজেকে রাজনৈতিক পরিচালক হিসেবে দেখি না।
চরিত্র আমাকে টানে, পরিচালিত করে। আমি তাকে কোনো নায়ক বা কোনো আন্দোলনের নেতা হিসেবে দেখাতে চাইনি। চেয়েছি একজন মানুষ হিসেবে দেখাতে এবং কীভাবে সে তার নিজের সমসাময়িক জগতকে পরিচালনা করে।
আপনার দেশের নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার অভিজ্ঞতা কি আপনি এই গল্পে বলতে চেয়েছেন?
আমি অবশ্যই আমার নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে লিখতে পারি না, আমি যা লিখেছি বা দেখিয়েছি, তা কোনো না কোনোভাবে আমি আমার দেশে পর্যবেক্ষণ করেছি বা অভিজ্ঞতা পেয়েছি। কিন্তু আমি চেয়েছি যারা এটা দেখবে, তারা সবাই যেন রেহানার সঙ্গে একাত্ম হতে পারে।
কানের লালগালিচায় প্রযোজক ও অভিনেত্রীর সঙ্গে পরিচালক সাদ। ছবি: সংগৃহীত
শুধুই আমার দেশের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে না। এক বন্ধু যখন বলল, এমন ঘটনা যেকোনো জায়গাতেই হতে পারে, ফ্রান্স বা ইউরোপের যেকোনো জায়গাতেই, তখন আমার মনে হলো, আসলেই এই গল্পটা যেকোনো জায়গার ক্ষেত্রেই মানানসই।
আপনি আপনার নায়িকার পরিশ্রম আর একাগ্রতা নিয়ে কথা বলেছেন। চরিত্রটাকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি কতটা একাগ্র ছিলেন?
ওর সঙ্গে আমি যখন প্রথম দেখা করে গল্পটা নিয়ে কথা বলেছিলাম, আমার হাতে তখনও পুরো চিত্রনাট্য ছিল না। আমরা রিহার্সালের ফাঁকে ফাঁকে চরিত্রটা নিয়ে কথা বলতাম। ওর মেয়ে ইমুর (রেহানার মেয়ের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছে আফিয়া জাহিন জাইমা) সঙ্গে ওর সম্পর্ক খেয়াল করতাম। আমি ওদের মধ্যে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছি যেখানে ওরা নিরাপদ বোধ করবে আর নিজেদের সঙ্গে মিশে যেতে পারবে।
চিত্রনাট্যের ফাইনাল ড্রাফটে বাঁধনের অনেক প্রভাব ছিল। কারণ, সে নিজেই একজন সিঙ্গেল মাদার। তার ৯ বছরের একটা মেয়ে আছে এবং তাদের দুজনের সম্পর্ক কেমন, সেটাও আমি দেখেছি। সবকিছু এক পাশে রেখে ৯ মাস ধরে সে এই চরিত্রের জন্য রিহার্সাল করেছে। আর্থিকভাবে আমরা তাকে যথেষ্ট সম্মানী দিতে পারিনি। কিন্তু তার নিজের এটা খুব মনে হচ্ছিল যে, সে এটা করতে চায়, আর তাই সিনেমাটাও তার কাঁধে নিয়েছে।
কানের ফটোকল আয়োজনে অভিনেত্রী বাঁধনের সঙ্গে সাদ। ছবি: সংগৃহীত
আপনার কি মনে হয় কান স্পটলাইটের কারণে বাংলাদেশি সিনেমায় মানুষ আরও আগ্রহী হবে?
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করি না। যতটা আড়ালে থাকা যায়, আমি সেটাই চাই। কিন্তু হ্যাঁ, এই অর্জন আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে অনেক সাহায্য করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, দেশের নতুন স্বাধীন ফিল্মমেকারদের এটা অনেক বেশি উৎসাহিত করবে। আমি অনেক মানুষের এমন অনেক ইতিবাচক মেসেজ পেয়েছি, যারা বিশ্বাস করে আমাকে বলেছে আমাদের সিনেমা কানে পৌঁছানো উচিত। এখন পর্যন্ত এই কথাটা ছিল স্বপ্নমাত্র। আমাদের সিনেমার অর্জনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এটাই যে, নতুন ফিল্মমেকারদের জন্য আমরা পথ দেখাতে পেরেছি।