বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘ঢাকা সে করাচি’: সংগীতে ভয়কে জয় শেখ দিনার

  •    
  • ২২ মে, ২০২১ ২০:৩২

বিভাজনের দুর্ভেদ্য দেয়াল শিল্প আর সংগীতে অতিক্রমের চেষ্টা রয়েছে ‘ঢাকা সে করাচি’ চলচ্চিত্রে। প্রায় ২৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের দুই শহর ঢাকা আর করাচি। এই দুই শহরের কয়েকজন সংগীত শিল্পী সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন এই চলচ্চিত্রে।

ইউটিউবে জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঢাকা সে করাচি’। বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় ঢাকা থেকে করাচি।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানকে থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ৫০ বছরে পড়েছে। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা এখনও ক্ষত তৈরি করে রেখেছে বাঙালির হৃদয়ে। রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতেও দুই মেরুতে দুই দেশ।

বিভাজনের এই দুর্ভেদ্য দেয়াল শিল্প আর সংগীতে অতিক্রমের চেষ্টা রয়েছে ‘ঢাকা সে করাচি’ চলচ্চিত্রে। প্রায় ২৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের দুই শহর ঢাকা আর করাচি। এই দুই শহরের কয়েকজন সংগীত শিল্পী সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন এই চলচ্চিত্রে।

ঢাকা সে করাচিতে প্রধান নারী চরিত্রে আছেন বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী শেখ দিনা। এটি নির্মাণের কয়েক মাস আগে তিনি ঘুরে আসেন করাচি শহর। অংশ নেন সেখানকার সংগীত উৎসবে।

বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যাওয়ার গল্পটা সহজ ছিল না। জাতিগত বিশাল বিভাজন, রাজনৈতির দূরত্ব, বিপদের শংকা আর মানসিক দ্বিধা অতিক্রম কীভাবে করেছেন, সেই গল্প নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন শেখ দিনা।

সংগীতশিল্পী শেখ দিনা। ছবি: সংগৃহীত

পরিচিত জন, স্বজন-পরিবার, এমনকি নিজের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়েছে দিনাকে। কঠিন সেই সময়ের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ২০২০ সালের মার্চের ৩ তারিখে পাকিস্তান গিয়েছিলাম। বাংলাদেশে যেমন ফোক ফেস্ট হয়, পাকিস্তানে সে রকম একটা ফেস্টিভ্যাল হয়, যেটার নাম ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ পারফর্মিং আর্ট (নাপা)। সেখানে আরও অনেক দেশের মিউজিশিয়ানরা গিয়েছিলেন। আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করি। ২২ মার্চ আমি দেশে ফিরে আসি।’

পাকিস্তান যাবার প্রস্তুতি যখন শেষ, সে সময় প্রবল চাপের মুখে দিনা সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথাও একবার ভেবেছিলেন।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার পরিচিত জন, বন্ধু-স্বজন এবং পরিবারের সদস্যরা পাকিস্তান যাবার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছিল। অনেকেই বলেছে, পাকিস্তানের ভিসা পাসপোর্টে দেখলে অন্য দেশের যেতে অসুবিধা হবে। আমি ঘাবড়ে যেতে থাকি, উৎসাহ হারাতে থাকি এবং ভাবতে থাকি যে থাক যাব না ফেস্টিভ্যালে। তবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার টানে, বাংলা ভাষা, বাংলা গান ছড়িয়ে দিতেই আমি শেষপর্যন্ত পাকিস্তান যাই।’

পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ পারফর্মিং আর্টস ফেস্টিভ্যালের আয়োজন। ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আরেকটি বিষয় ভেবেছিলেন দিনা। সেটা হলো, বাংলাদেশে যখন ফোক ফেস্ট হয়, তখন তো অনেক পাকিস্তানি শিল্পী এখানে আসেন। এমনকি ঈদের সময় প্রচুর পাকিস্তানি পোশাক আসে বাংলাদেশে। সেগুলো এদেশের মানুষ পরেও। তাহলে তিনি পাকিস্তানে গেলে সমস্যা কোথায়!

বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে শেষপর্যন্ত পাকিস্তানে যান শেখ দিনা। সেখানে গান করার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সে যে এক কেমন অনুভূতি, আমি বলে প্রকাশ করতে পারব না। ফেস্টিভ্যালে আমার একটি গান ছিল- আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে? আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি, পরান বান্ধিবি কেমনে?

‘এই গানটির সঙ্গে একটা পারফর্মেন্স ছিল। সেটা এমন, একজন নারী নৃত্যশিল্পীর তার হাত-পা-মুখ বাঁধা, সে ধীরে ধীরে তার বাঁধন খুলে নৃত্য করতে শুরু করে।

পাকিস্তানের এআরওয়াই নিউজ চ্যানেলে ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটি পরিবেশন করছেন শেখ দিনা। ছবি: সংগৃহীত

“এই গানটি গাওয়ার সময় আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আমি কাঁদছিলাম আর গানটি গাইছিলাম। আমার সেই নারীদের কথা মনে পড়ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য, ভাষার জন্য সম্ভ্রম হারিয়েছেন। আমি পাকিস্তানের এআরওয়াই নিউজ চ্যানেলের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে ‘ও আমার দেশের মাটি গানটি গেয়েছি। আমি ওদের প্রচুর বাংলা গান শোনাতে চেয়েছি এবং শুনিয়েছিও।”

পাকিস্তানে সেই সংগীত উৎসবে দিনা ব্যাপক সমাদৃত হন। সেখানকার সাউন্ড অফ কোলাচি নামের একটি ব্যান্ডের সঙ্গে দিনা ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করেন। পরে ওই ব্যান্ড দলের সদস্যরাই দিনার বন্ধু হয়ে যায়।

তার সেই পাকিস্তানি বন্ধুরা বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবেন, সে কথাও নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন দিনা।

‘আমি যে প্রজন্মের সঙ্গে মিশেছি, তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কিছু জানে না। তারা শুধু জানে যে, একটা ঝামেলা হয়েছিল। আরেকটা বিষয় তারা জানে যে, বাংলাদেশি নারীদের পাশবিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল।’

‘ঢাকা সে করাচি’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অবশ্য দুই দেশের সংঘাতের বিশদ বিবরণ নেই। তবে দূরত্বের দুর্ভেদ্য দেয়ালের প্রসঙ্গ আছে, সেই সঙ্গে আছে বিভেদের পরেও কাছাকাছি আসা মানুষের বাধা অতিক্রমের আকুতি।

পাকিস্তানে যাওয়ার আগে দিনার মানসিক দ্বন্দ্ব চিত্রায়িত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। আর আছে কিছু সুন্দর সংগীত। এই গান আর সুরের টানেই সব ভয় ভেঙে পাকিস্তান উড়াল দিয়েছিলেন দিনা।

সংগীতশিল্পী শেখ দিনা। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের মেয়ে দিনা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। সংগীতকে পেশা হিসেবে নেয়ার ইচ্ছা নেই। তবে সংগীতের প্রতি ভালোবাসা প্রগাঢ়। দেশের সংগীতকে দেশের বাইরেও ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। ২০১৮ সালে গড়ে তোলেন নিজের ব্যান্ড ‘একতারা’।

দেশের বাইরে দিনার প্রথম পারফরম্যান্স ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে। ২০১৯ সালের আগস্টে একাই সেখানে যান তিনি। বার্মিংহাম কনটেম্পোরারি মিউজিক গ্রুপের আয়োজনে ট্রান্সফর্মিং ন্যারেটিভ বাংলাদেশ, বার্মিংহাম ও পাকিস্তান নামের একটি আয়োজন হয়েছিল সেখানে। ১৫টি দেশের মিউজিশিয়ানরা যোগ দেন আয়োজনে।

দিনা বলেন, ‘ওখানেই আমার পরিচয় হয় পাকিস্তানের শিল্পীদের সঙ্গে। তখন তারা আমার বন্ধু ছিল না। এখন হয়েছে। তারাই বলে যে, আমাদের দেশে একটা ফেস্টিভ্যাল হয়, সেখানে তোমার নাম দেব আমরা। এভাবে যোগাযোগ শুরু এবং ফেস্টিভ্যালে অংশ নেয়া।’

২০২০ সালে সংগীত নিয়ে আবারও ইংল্যান্ডে যাবার সুযোগ আসে দিনার। তবে কোভিড ১৯ মহামারির কারণে যেতে পারছিলেন না। তখন আর্ট কাউন্সিল ইংল্যান্ড, ব্রিটিশ কাউন্সিল, ট্রান্সফর্মিং ন্যারেটিভ মিলে শর্টফিল্ম তৈরির পরিকল্পনা করে। ততদিনে দিনা ঘুরে এসেছেন পাকিস্তান।

দিনা ও তার পাকিস্তানি বন্ধুরা মিলে ‘ঢাকা সে করাচি’ নির্মাণের পরিকল্পনা জমা দিলে সেটি অনুমোদন পায়। দিনা বাংলাদেশ থেকে এবং তার পাকিস্তানি বন্ধুরা পাকিস্তানে দৃশ্যধারণ করে নির্মাণ করেছেন এই শর্টফিল্ম।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে এটি আপলোড হয় ইউটিউবে। যেখানে উঠে এসেছে ভয় জয় করার গল্প। দিনা বলেন, ‘এটি আমার গল্প। সত্য গল্প।’

এই সত্য খুঁজে নেয়ার শক্তি অর্জন করেছেন সংগীতের শক্তিতে।

শেখ দিনার ফেসবুকে একটি পেজ আছে। সেখানে নামের পাশে বৈষ্ণবী শব্দটি ব্যবহার করেছেন তিনি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার খুব কাছের এক বন্ধুর দেয়া নাম। তাই এটা ব্যবহার করেছি।’

এ বিভাগের আরো খবর