টেলিভিশন বা ইউটিউব নাটক বলতেই ভেসে ওঠে মেহজাবিন চৌধুরীর বুদ্ধিদীপ্ত মিষ্টি মুখ। নারী দিবসে মেহজাবিন নিজের ভাবনা জানিয়েছেন নিউজবাংলাকে।
নারী দিবসে বরাবরই টেলিভিশন নাটক বা বিজ্ঞাপনে আমরা নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীদের গল্পই দেখি? নারীদের সফলতার গল্প কেন উদযাপন করি না?
আমার মনে হয় এর পেছনে দুটো কারণ। দর্শকের দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে, তারা সবসময় অনুপ্রেরণার গল্প চায়। যেখানে তারা দেখতে চায় চোখের সামনে কীভাবে একটা মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যে মানুষটা সাফল্য পেয়ে গেছে, তার সফলতার পেছনের গল্পের চেয়ে এ জিনিসটা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
আপনি যে সফল নারীদের কথা বলছেন তাদেরও একটা সংগ্রাম আছে। এ লড়াইটা কম বেশি সব নারীর ক্ষেত্রে একই রকম। আমরা তাদেরকেই উৎসাহী করতে চাই, যারা মনে করে না যে তারা প্রতিবাদ করতে পারবে বা তাদের সেই ক্ষমতা আছে।
ধরুন একজন শ্রমিক, তার সঙ্গে যখন অন্যায় হয়, সে প্রতিবাদ করার আগে অনেক কিছু ভাবে। তার সমাজ, পরিবার, আশেপাশের মানুষদের কথাও সে নারী শ্রমিককে ভাবতে হয়। এ ধরনের মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকে।
কারণ কোনো ধনী নারীর প্রতি সমাজ এতটা আক্রমণাত্মক নয়, যতটা একজন নিম্ন বা মধ্যবিত্ত নারীর প্রতি। আর সবসময় দেখা যায় তাদেরকেই নির্যাতন করা হয় বা হ্যারেস করা হয়, যাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা কম। আমরা আসলে নাটক, টিভিসি বা সিনেমার মাধ্যমে এমন নারীদেরই উৎসাহিত করার চেষ্টা করি, যাদের আশেপাশে সুযোগ-সুবিধা ও সাহসের জায়গাটা কম থাকে। তাদেরকেই ইন্সপায়ার করাটা সব থেকে জরুরি।
কিন্তু তাদের প্রতিবাদ করার যতটুকু অধিকার আছে, অন্যায়ের শিকার হওয়া একজন স্বাবলম্বী নারীরও প্রতিবাদের ততটুকুই অধিকার আছে। কিন্তু সফল নারীদের প্রতিবাদের ফলে তাদের পরিবার, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে সাহায্য আসতে পারে, যেটা একজন শ্রমিক বা দিনমজুরের জন্য নাও হতে পারে।
মেহজাবিন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
মাত্র এক দিন এ ধরনের গল্প বলে কি আসলেই মানুষকে অনুপ্রাণিত করা সম্ভব?
এর থেকে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না যে, ২০২১ সালে এসেও নাটক, সিনেমা, ওভিসি বা টিভিসি বানিয়ে মানুষকে নারীর মর্যাদা, নারীর ভূমিকা মনে করিয়ে দিতে হয়। কারণ প্রতিনিয়ত একজন নারী সে গৃহিণী হোক, শিক্ষক হোক, ডাক্তার হোক, ওয়ার্কিং উইমেন হোক, শ্রমিক হোক, যাই হোক না কেন, তাদের সবারই সংগ্রাম আছে।
অনেকেই মনে করে যে, হাউজমেকারের কোনো স্ট্রাগল নাই কারণ তার জন্য সব কিছু রেডি হয়ে চলে আসছে। কিন্তু একটা বাসা সামলানো যে অনেক বড় একটা দায়িত্ব এটা অনেকেই বোঝে না। এটা নিয়ে যে এখনও সচেতনতা তৈরি করতে হচ্ছে এটা দুঃখজনক। আমাদের সমাজ ও মানসিকতা এখনও এতটুকু উন্নত না। এজন্য এই বিশেষ দিনগুলোতে আমরা তাদের আরও একবার মনে করিয়ে দেই।
মেহজাবিন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
এ কথা অনেকেই বলেন যে, নারীরাই নারীদের সফলতায় বাধা। এ কথাটা মিডিয়াতে কতটুকু সত্যি বা ভুল?
আমি শুধু মিডিয়ার কথা আলাদা করে বলব না। দেখা যায় অনেক পরিবারে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে মেয়েদের এমনভাবে বড় করা হয় যে, তারা সবসময় ভয় পেয়ে থাকবে, নিজের একটা কাজ করার আগে অনেক বার ভাববে, তাদেরকে সবাই একটু অন্যভাবে দেখবে, সচেতন হয়ে চলবে বা আত্মত্যাগী হয়ে চলতে হবে- এই শিক্ষাগুলো বাসা থেকেই শুরু হয়।
আমরা আমাদের মায়েদের কাছ থেকেই অনেক কিছু শিখি। আমাদের বাসায় যদি এ ধরনের শিক্ষার পরিবর্তন না হয় তাহলে দেখা যাবে প্রথম বাধাটা পরিবার থেকেই আসছে।
মেহজাবিন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
পরিবার থেকে যা শেখানো হয় তা আমাদের জীবনে পরবর্তীতে প্রতিফলিত হয়। তাই আমাদের সংস্কৃতিতে যদি আমরা এই পরিবর্তনটা আনতে পারি, তাহলে দেখা যাবে কাজের ক্ষেত্রে বা অন্য যেকোনো জায়গায় আমরা সহনশীল হব ও সাহায্যের মানসিকতা তৈরি হবে। কাউকে হেয় করে দেখব না।
মেহজাবিন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
নাটক, সিনেমা বা বিজ্ঞাপনে পুরুষরা নিজেদের ইচ্ছা মতো নারীদের উপস্থাপন করে, বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
বিশ্বব্যাপী এ সমস্যাটা আছে। নারীদের শো-পিস হিসেবে দেখানো হয়। প্রয়োজন না থাকলেও আইটেম সং রাখা হয় দর্শক আকর্ষণের জন্য। আমার মনে হয় এ জিনিসটা সেদিন বন্ধ হবে, যেদিন আমাদের দর্শক এগুলোকে দেখতে চাইবে না। দর্শকের রুচির ওপর আসলে অনেক কিছু নির্ভর করে।
আপনি যখন দেখবেন এমন একটা আইটেম সং আছে যেটা পরিবার নিয়ে দেখার মতো না, কিন্তু দর্শকের কাছে সেটার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি, তখন প্রযোজক বা পরিচালক বা মিডিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাথায় একটা জিনিসই খেলবে- এটা তো হিট। কিন্তু জিনিসটা যে নেগেটিভ, এটা আমাদের বুঝতে হবে। দর্শকদেরকেই বলতে হবে এটা আমরা চাই না।
একজন প্রযোজক, পরিচালকের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি দর্শকেরও দায়িত্ব আছে। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, কতটুকু তারা দেখতে চায় বা চায় না, কতটুকু দেখতে চাওয়া উচিত বা না হলেও চলে, এটা দর্শকরাই ঠিক করবে।
মেহজাবিন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
একজন অভিনেত্রী হিসেবে এ পরিবর্তনের ধারায় নিজেকে সামিল করতে আপনি কী করেন বা করতে চান?
করতে চাই অনেক কিছু। প্রতিটা মানুষই যখন একটা জায়গায় পৌঁছায় এবং সে পজিটিভ কিছু করতে চায়, তার কাছে অনেক সুযোগ থাকে। আমি বা অন্য অভিনেত্রীদের কথা যদি বলি, তারা নিজেদের জায়গা থেকে সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেস তৈরি করে যাচ্ছে। সেটা বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা বা ফেসবুকের স্ট্যাটাসের মাধ্যমেই হোক না কেন। আমি বলব না যে দিন বদলাচ্ছে না। অবশ্যই বদলাচ্ছে, কিন্তু খুবই ধীর গতিতে।
মেহজাবিন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
সবার কাছে অনুরোধ থাকবে যে, নারীকেন্দ্রিক কাজগুলোকে যেন একই ভাবে মূল্যায়ন করা হয়। দর্শকের কাছে অনুরোধ থাকবে, নারীকেন্দ্রিক কনটেন্টগুলো দেখুন। এ পরিবর্তনটা আনার জন্য দর্শকের অনেক বড় ভূমিকা আছে। আমি আশা করি তারা এ ভূমিকা পালন করবেন।