চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নারীর অবস্থান, মানসিকতা, লড়াই ও মুক্তির কথা যে কয়জন নারী গল্পকার ও পরিচালক বলতে চেয়েছেন, তাদের মধ্যে রুবাইয়াত হোসেন অন্যতম।
নারীর ভালোবাসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির নারীর মানসিকতা, সংগ্রাম ও মুক্তির কথা তিনি গল্পের মাধ্যমে জানাতে চেয়েছেন। আর সেই চাওয়া থেকে তৈরি হয়েছে মেহের, রয়া ও শিমুর মতো চরিত্র। এই চরিত্রগুলো দিয়েই রুবাইয়াত দেখিয়েছেন নারীর প্রতি সমাজের নানান অসংগতি এমনকি নারীর নিজের সঙ্গে নিজের দ্বন্দ্ব ।
এই অসংগতি নির্মূল করতে ক্যামেরা নিয়ে নামেননি রুবাইয়াত। তিনি শুধু দেখাতে চান সমস্যাগুলো কোথায়। নারীর জন্য একটা ভালো পরিবশ তৈরির স্বপ্ন দেখেন এই পরিচালক।
সংক্ষেপে রুবাইয়াতের তিনটি সিনেমার ধরন
মেহেরজান (২০১১)- বিপরীত অবস্থানে থেকেও একজন নারীর ভালোবাসার গল্প। বাঙালি মেহের চরিত্রের সঙ্গে একজন পাকিস্তানি সৈন্যের প্রেম, মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখানোর অভিযোগে সিনেমাটির প্রদর্শন বন্ধ করা হয়।
আন্ডার কনস্ট্রাকশন (২০১৫)- শহুরে জীবনে এক আধুনিক নারীর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সংগ্রাম নিয়ে সিনেমা।
মেড ইন বাংলাদেশ (২০১৯)- নারী পোশাকশ্রমিকদের সংগ্রাম ও মুক্তির গল্প।
সিনেমার ধরন থেকেই বোঝা যায় নারী হয়ে নারী জীবনের বিভিন্ন ভাগ নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন এবং তা দিয়ে বানিয়েছেন সিনেমা।
এখন রুবাইয়াত আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। করোনার কারণে সেখানে আটকে গেছেন। তিনি চাইছেন ভ্যাকসিন নিয়ে দেশে ফিরতে। সেখান থেকে নারী ও চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছেন নিউজবাংলার সঙ্গে।
রুবাইয়াত, আশা করছি ভালো আছেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আপনি অনেকটা এগিয়ে গেছেন। আপনার সিনেমা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে দেখানো হচ্ছে। বাইরের প্রযোজকরা আপনার সিনেমায় প্রযোজনা করছে। কিন্তু আপনি ছাড়া অন্য কোনো নারী পরিচালকের সঙ্গে এমনটা হচ্ছে না। একা এগিয়ে যাওয়াকেই কি উন্নয়ন বলবেন?
না, আমার কাছে একা এগিয়ে যাওয়া কখনই উন্নয়ন মনে হয় না। আমি একা অস্কার পেলে কোনো লাভ হবে না। আমার পরে যদি আরও একশ নারী নির্মাতা বা নারী চলচ্চিত্র কর্মী উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন তাহলেই আমাদের উন্নয়ন সম্ভব। তার জন্যই আমার কিছু পরিকল্পনা আছে।
সেটা কেমন?
তার সবকিছু এখনই বলতে চাই না। তবে ‘সুলতানাস ড্রিম- ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। এটা একটা প্রতিযোগিতা। এখানে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছে। চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু ছিল নারীদের প্রতি যৌন সহিংসতা ও তার প্রতিবাদ।
আমি বিস্মিত হয়েছি যে, কত কত প্রস্তাব এখানে জমা পড়েছে। আজ নারী দিবসেই আমরা বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করব। ফিকশন, ডকুমেন্টারি, অ্যানিমেশন কিংবা নিরীক্ষামূলক ক্যাটাগরিতে ৫ থেকে ৮ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তারা অনুদান পাবে।
আয়োজনের সহ–আয়োজক হিসেবে থাকছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খনা টকিজ। পরিবেশকের দায়িত্বে আছে গ্যেটে ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ।
নতুন সেই নির্মাতাদের সমস্যা বা ভাবনার সঙ্গে একই বয়সে আপনার সমস্যা বা ভাবনার কোনো পার্থক্য পাচ্ছেন?
এটা এখনও বলতে পারছি না। কারণ তাদের সঙ্গে আমাদের বিস্তারিত আলাপ হয়নি। সিনেমার বিষয়বস্তু, নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা হবে তখন ভালো করে বিষয়গুলো বুঝতে পারব।
আপনি সবসময় কাজের মধ্যেই থাকেন। সিনেমার ভাবনা ছাড়াও নানা বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছা আপনার। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধর্ষণের অনেক ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের শিকার নারীদের সঙ্গে অনেকসময় এমন আচরণ করা হচ্ছে যে, এটা তাদেরই ভুল। বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কোনো সিনেমা করার পরিকল্পনা আছে কি?
না, এমন কোনো বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাবনা এই মুহূর্তে নাই। বিষয়টা নিয়ে বলতে চাই, যখন কেউ ছিনতাইয়ের শিকার হন বা খুন হন, তখন কি আমরা বলি যে, যিনি ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন তার দোষ বা যিনি খুন হয়েছেন সেটা তার দোষ? না, আমরা বলি না। কিন্তু ধর্ষণের শিকার নারীর ক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এমন। এটা খুব দুঃখজনক।
তা ছাড়া আমি যুক্তরাষ্ট্রে একজন প্রযোজকের সঙ্গে কিছু পরিকল্পনা করছি। আমরা কিছু শর্টফিল্ম বা কনটেন্ট বানাব। এই কাজগুলোতে একটু ব্যস্ত।
এখন কিন্তু সিনেমার চেয়ে আমার অন্য আরেকটা ভাবনা বেশি কাজ করছে। আমি যতটুকু করতে পারছি, করছি। কিন্তু আমার দেশের নারীরা, যারা সিনেমা বা সিনেমা সংশ্লিষ্ট কাজ করতে চায়, তাদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম করতে চাই। এটা এখন আমার ভাবনার পঞ্চাশ ভাগ নিয়ে নিয়েছে। সেটা নিয়েও ভাবছি, কাজ করছি। আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে সবাইকে জানাব।
অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার ফলে নারীরা আরও অগ্রসর হতে পারছে। কিন্তু নারীর জন্য সিনেমা সংশ্লিষ্ট কাজ অর্থের বিচারে কতটা ভালো?
নারী বা পুরুষ- কারও জন্যই সিনেমা পেশা ভালো না। বিশেষ করে যারা স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। আমি নিজেই অনেকদিন পর পর সিনেমা বানাই। আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন, তারা নিশ্চয়ই আরও কাজ করতে চান। কিন্তু আমি তো সেভাবে কাজ করতে পারি না বা চাইও না।
আমি এখন গল্প এবং নির্মাণের পাশাপাশি শিক্ষকতা পেশার কথাও ভাবছি।
এই যে সিনেমা বানাচ্ছেন, ভাবছেন বা ভাবাচ্ছেন। এতে করে নারীর জন্য ভালো কোনো পরিবেশ তৈরি হবে বলে মনে করেন?
সিনেমা দেখে দর্শকরা কীভাবে এর আবেদন গ্রহণ করেন সেটা দর্শক ভালো বলতে পারবেন। আমি বা আমার ইউনিট এবং আমার অভিনয়শিল্পীদের কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসে বলে আমার মনে হয়। আমরা যখন আমার সিনেমার বিষয়, সংলাপ নিয়ে দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করি, তখন মানসিকভাবে আমাদের একটা পরিবেশ তৈরি হয় বলে আমার ধারণা।
আপনার সিনেমার কোন নারী চরিত্রকে আপনার বেশি শক্তিশালী বা উতরে যাওয়ার মতো মনে হয়?
আমার কাছে মনে হয়েছে মেড ইন বাংলাদেশ সিনেমায় শিমু চরিত্রটি অনেক সংগ্রামী এবং জয়ী। কারণ এত সমস্যার মধ্যেও তারা গার্মেন্টে ইউনিয়ন করে, নিজের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে, বঞ্চিত হয়, আবার আদায়ও করে নেয়।
সেই তুলনায় আন্ডার কনস্ট্রাকশনের রয়া চরিত্রটি কিন্তু তার অবস্থান থেকে উঠতে পারে না। একই জায়গায় পড়ে থাকে। অথচ অর্থনৈতিকভাবে রয়া অনেক ভালো অবস্থানে আছে।
শ্রমিকদের নিয়ে মেড ইন বাংলাদেশ সিনেমাটির একটি বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছিল ফ্রান্সে। সবাই সিনেমাটি দেখে বলেছিল, সব দেশে সিনেমাটি দেখানো প্রয়োজন।
এটাই হলো সিনেমার শক্তি।