অ্যানিমেশন সিনেমাগুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতি তুলে আনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ওয়াল্ট ডিজনি। তবে গত ৯০ বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো কাহিনি স্থান পায়নি এ প্রতিষ্ঠানটির এ ধরনের সিনেমায়।
দেরিতে হলেও সে শূন্যতা পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে ডিজনি। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি তুলে ধরা একটি অ্যানিমেশন সিনেমা নির্মাণ করেছে। গত শুক্রবার সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে।
রায়া অ্যান্ড দ্য লাস্ট ড্রাগন সিনেমার প্রধান চরিত্রে দেখা যায় রায়া নামের এক মেয়েকে। সে তার জনগোষ্ঠীর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি পৃথিবীকে বাঁচাতে ভ্রমণে নেমে পড়ে।
রায়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতীক হিসেবে সিনেমায় দেখানো হলেও আসলেই কোন দেশ বা কোন সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে তাকে দেখানো হয়েছে, সেটি স্পষ্ট বিষয় নয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ১১টি দেশ ও ৬৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষ রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে অন্তত হাজার রকমের সংস্কৃতি আছে। রায়া তাহলে কোন সংস্কৃতিকে ধারণ করে, সে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
সিনেমার গল্প শুরু হয় কুমান্দ্রা নামের কল্পিত এক রাজ্যে। এ রাজ্যে পাঁচটি জাতিগোষ্ঠীর বাস যাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় রয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, এ পাঁচ জাতিগোষ্ঠী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচ অঞ্চলের বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সিনেমার পরিচালক ডন হল বিবিসিকে জানান, তিনি ও তার সিনেমার ক্রুরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঘুরতে গেলে ওই অঞ্চলের ওপর চলচ্চিত্র বানানোর কথা মাথায় আসে।
রায়া অ্যান্ড দ্য লাস্ট ড্রাগন সিনেমার পোস্টার
সিনেমার গল্প বর্তমান সময়কে ধারণ করে না। হাজার বছর আগের সময়কে কল্পনা করেই এগিয়ে যায় কাহিনি।
এটি খুবই পরিষ্কার যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল নিয়েই সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে। সিনেমার নায়িকা রায়াকে দেখা যায় ‘সালাকোট’ নামের টুপি পড়তে, যা ফিলিপাইনের মানুষেরা পড়ে থাকে।
অনুগত বন্ধুকে পরিবহন হিসেবেও ব্যবহার করে রায়া, যার নাম দেয়া হয়েছে টুক-টুক। ফিলিপাইনের খুব পরিচিত রিকশার নাম টুক-টুক।
রায়া লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা পেয়েছে ‘সিলাত’ নামের মার্শাল আর্ট থেকে, যা মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে বেশি ব্যবহার করা হয়।
প্রযোজক ওসনাত সুরের বলেন, যে চিন্তাগুলো একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেয়া যায় (যেমন: গোষ্ঠীগত চিন্তা ও একসঙ্গে কাজ করা) সেগুলোকে তারা সিনেমায় গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন।
অনলাইনে মন্তব্যকারীরা জানান, তাদের কাছে মনে হয়েছে এই সিনেমায় ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন সংস্কৃতির টুকরো টুকরো কিছু অংশ দেখানো হয়েছে, যা তাদের ভালো বলে মনে হয়নি।
এ সিনেমার সহ-চিত্রনাট্যকার অ্যাডেল লিম (যিনি একজন মালয়েশিয়ানও) বলেন, ‘সাংস্কৃতিক অনুপ্রেরণা নিয়ে বলতে গেলে এমন একদমই হয়নি যে আমরা কোনো একটা জিনিস দেখলাম এবং ভাবলাম যে এই জিনিসটা গল্পের সঙ্গে মানাবে, তাই অন্তর্ভুক্ত করলাম; আমরা এমন চিন্তা থেকে আরও গভীরভাবে ভেবেই সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো রেখেছি।
‘উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিনেমায় রায়ার বাবার স্যুপ বানানো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষরা তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে খাবারের মাধ্যমে। এই জিনিসটা আমার মনে দাগ কেটেছে।’
ইন্দোনেশিয়ার এক টুইটার ব্যবহারকারী বিবিসিকে জানান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবগুলো সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করা ‘অসম্ভব’ ব্যাপার। তার কাছে মনে হয়েছে, সিনেমাটি শুধু একটি অঞ্চল বা সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে তৈরি করলে ভালো হতো।
রায়া অ্যান্ড দ্য লাস্ট ড্রাগন সিনেমার দৃশ্য
সিনেমাটির আরেক সহ-চিত্রনাট্যকার কি নুয়েন বলেন, ‘আমাদের সুযোগ হয়েছে ওরিজিনাল একটি গল্প বলার যার ডিএনএ আসল জায়গা থেকে নেয়া হবে। আমরা এমন কোনো গল্প বলতে চাইনি যেখানে থাইল্যান্ডের মানুষদের খারাপ দেখানো হবে বা মালয়েশিয়ার মানুষদের ভালো দেখানো হবে। তাই এমনভাবেই দেখানোটাই আমরা ঠিক মনে করেছি।’
মালয়েশিয়ার ওপেন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড লিম বিবিসিকে বলেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় পরিচয় আসলেই কী তা নিয়ে তারা (অঞ্চলটির বিভিন্ন দেশের বাসিন্দা) নিজেরাই এখনও চিন্তায়।’
তিনি জানান, উপনিবেশগুলোতে সাম্রাজ্য বিস্তারকারী দেশের প্রভাব দেখা যায়, যা সাংস্কৃতিক বিনির্মাণেও ভূমিকা রাখে। যেমন: ভিয়েতনাম ফ্রান্সের এবং ইন্দোনেশিয়া নেদারল্যান্ডসের উপনিবেশ ছিল।
তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা আমরা নিজেদের কীভাবে দেখি, কোন সংস্কৃতিকে আমরা আঁকড়ে ধরতে চাই বা আমরা নিজেদের কীভাবে পরিচয় দেই, সে ধারণায় প্রভাব ফেলেছে উপনিবেশের ইতিহাস।
‘আমার সন্দেহ হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়রা নিজেদের অঞ্চলের চেয়ে উপনিবেশকারী দেশগুলো সম্পর্কে বেশি জানে। যেমন: ভিয়েতনাম থাইল্যান্ডের চেয়ে ফ্রান্স সম্পর্কে বেশি জানে।’