আমরা যখন তরুণ বয়সে বাংলাদেশের সিনেমা ও নাটক দেখতাম, শুনতাম, তখন এই নামটাই একটা বিশাল বড় ব্যাপার ছিল। এটিএম শামসুজ্জামান। সিনেমা হলে যখন মাইকিং করে অ্যানাউন্স করা হতো কে কে আছেন ছবিতে; যেমন- গোলাম মোস্তফা, শওকত জামান, হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, কবরী এবং এটিএম শামসুজ্জামান। এটিএম শামসুজ্জামান মানে এটিএম শামসুজ্জামান। তিনি এক, অনন্য।
আমার কাছে প্রথম যখন একটু বোঝার জায়গা তৈরি হলো, দেখলাম গ্রামবাংলার চরিত্রে তার যে ভিলেন চরিত্র, সেটার যে দ্যোতনা অন্য রকম উপস্থাপনা, সেটা প্রথম পাওয়া গেল একটা স্বাভাবিক কিন্তু শয়তানি ঢংয়ে, যার কথা শুনলেই গায়ের মধ্যে জ্বলে উঠত।
পরে যখন অভিনয়ে গেলাম, ওনার (এটিএম শামসুজ্জামানের) সঙ্গে যখন এফডিসিতে দেখা হলো, তখন খুব হাসিমুখে ওয়েলকাম জানাতেন এবং এমনভাবে কথা বলতেন যেন উনি আমার খুব পুরোনো চেনা মানুষ।
টেলিভিশন থেকে এক ধরনের দূরত্ব ছিল, অভিনয় করতেন না প্রথম দিকে। সে সময় উনি ওখানে (চলচ্চিত্রে) ছিলেন। এ ছাড়া কিছু ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ হয়েছিল বলে আমি জানি।
এটিএম ভাই কিন্তু প্রথম সংশপ্তকের রমজান। মামুন ভাই ওনাকেই কাস্ট করেছিলেন প্রথমে। কবরীকে দিয়েছিলেন রাবু, সুবর্ণা করেছিল যেটা।
ভীষণভাবে তার নিজস্বতা নিয়ে আমাদের সামনে তিনি সব সময় হাজির হয়েছেন। মানুষটা এত বন্ধুবৎসল, যেটা চিন্তা করা যায় না। বয়সের কোনো পার্থক্য ছিল না। আমরা হোক, তার আগের জেনারেশন হোক, তার অদ্ভুত অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হতো। বিশেষ করে তার সঙ্গে গল্প শুনতাম খলিল ভাইয়ের। খুনসুটি লেগেই থাকতো। এ ওর পেছনে লেগে থাকত-এমন বহু গল্প।
আমার সঙ্গে একটা গল্প শেয়ার করি। আমার সঙ্গে একদিন মজা করতে করতে বলছিলেন, খুব মজার মানুষ ছিলেন তো। উৎপল দত্তের সঙ্গে ‘অবিচার’ ছবিতে উনি একটা ক্যারেক্টার করছিলেন।
রিহারসেলে উনি সঙ্গে স্ত্রীকে নিয়ে গেছেন। উৎপল দত্ত তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে, তোমার ওয়াইফ? উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন না, উনি আমার স্ত্রী। উৎপল দা বললেন ওয়াইফ বললাম তখন মাথা নাড়লে কেন? উনি তখন বললেন, আমি তো অশিক্ষিত মানুষ, ওয়াইফ মানে কী আমি তো জানি না।
এটিএম ভাই মানেই গ্রামের খলচরিত্র। অপ্রতিদ্বন্দ্বী!
ফরিদী এটিএম শামসুজ্জামানের চরম একজন ভক্ত ছিলেন। আবার ফরিদীরও ভক্ত ছিলেন এটিএম ভাই। দুই জন দুই জনকে ফলোও করতেন একভাবে। ফরিদী গ্রামবাংলার ভিলেনের মধ্যে অন্য ধরনের চরিত্র নিয়ে এসেছে। অভিনয়ে আসার পর আমি বিশ্বাস করাতে পারছি কি না যে আমি গ্রামের লোক, আমি খারাপ মোড়ল কিংবা চতুর ব্যবসায়ী বা ক্যারেক্টারের যে লাইনটা থাকে, সেটা বিশ্বাস করানোটাই সবচেয়ে বড় মনে করি আমি।
আমি ভাবতে চাই না এটিএমের আগের চরিত্রে কী দেখেছি, পরের চরিত্রে কী দেখব। কিন্তু ইফ ইট ইজ বিলিভেবল অ্যান্ড হি ক্যান মেইক ইট, দর্শককে বিশ্বাস করানো যে এই লোকটা এত খারাপ! আমার মায়েদের দেখেছি, উনি স্ক্রিনে আসার সঙ্গে সঙ্গে এমন বলতেন, উনি বিচ্ছিরি লোক!
এই যে একটা সাধারণ পার্সপেক্টিভ থেকে একজন মানুষকে দেখা। আমাদের নির্মাতারা বিশেষ করে মূলধারার চলচ্চিত্রের সঙ্গে যারা আছেন, তারা খুব পরিবর্তন দেখাতে চান না বা দেখাতে পারেন না। এটিএম ভাইও সে অর্থে চরিত্রে পরিবর্তন আনতে পারেননি, টেলিভিশনেও তাকে আমরা একই রকম চরিত্রে দেখেছি।
উনি খুব ভালো একজন লেখক ছিলেন, যেটা আমাদের চলচ্চিত্র জগতে খুব কম এসেছে। শেষবার ওনার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে উনি আমার বাড়ির নিচে এসেছিলেন এবং একটা গল্প লেখার কথা বলছিলেন। এক ধরনের অসহায়ত্ব একজন শিল্পীরও থাকে। তাকে করে খেতে হয়, খুব বেশি বাইরে যাওয়ার অবকাশ থাকে না এবং ইন্ডাস্ট্রিতেও সেভাবে সুযোগ থাকে না।
সংশপ্তকে সে সময়ে তার রমজানের গেটআপ চিকন একটা মোচ, চোখের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে, মনে হয় যেন একটা তরঙ্গ। এইটা খুব দরকার।
শাইখ (নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ) স্যারের কথা বলার একটা স্টাইল ছিল। এটিএম ভাই সে কথা বলার স্টাইল নকল করতে করতে তার ক্যারেক্টারের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। আমরা তখন মজা করে বলতাম আপনি তো শাইখ স্যারের একদম সাগরেদ হয়ে যাচ্ছেন। উনি বলতেন এটা আর না করে থাকতে পারি না, ঢুকে গেছে ভেতরে।
আমার সঙ্গে ওনার কাজ করার সুযোগ তেমন মেলেনি। ‘সুরুজ মিয়া’ নাটকে কাজ করার কথা ছিল। গ্রামের একটা চরিত্র কিন্তু এটিএম ভাই করতে পারেননি। কিন্তু অদ্ভুত রকমের একটা বন্ধুত্ব ছিল তার সঙ্গে। উনি কিন্তু কানে শুনতেন না। উনি এক দিন গল্প করতে করতে বলছিলেন, ‘বুঝছো তারিক, এই পোলাপানগুলো এতো পাজি। আমি তো কানে শুনি না। জাহিদ আছে, আপনার শিষ্য। ওর ডায়লগ বলার কথা, আমি তো লিপ দেখে বুঝি যে কী বলতেছে। ওরা তো সেটা জানে না। ওরা মনে করছে এটিএম তো কানে শোনে না। ওরা আমারে গালাগালি দিয়া ডাইলগ বলতেছে। আমি জাহিদরে বললাম, তুই কি আমারে গালি দিলি? সে বলে আপনি বুঝলেন কেমনে? আমি বললাম আমি লিপ রিড করতে পারি।’
এরকম মনোযোগ ছিল। লিপ রিড করে ক্যারেক্টারের কিউ ধরতেন তিনি।
আমরা যখন ফরিদীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী করলাম শিল্পকলা একাডেমিতে, আর কেউ নাই এটিএম ভাই চলে আসছেন। বললেন ফরিদীর অভিনয় আমার এত ভালো লাগত, আমার কাছে উনি বাংলাদেশের এক অসামান্য অভিনেতা। আরেকটা প্রজন্মকে রিকগনাইজ করা, এই উদারতা, এই লোকগুলো হারিয়ে যাওয়ার এটাই কষ্ট।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব