১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নেয়া লোকটি একদিন গান ধরেছিলেন, ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে...।’
কাকতালীয়ভাবে আরেক ফেব্রুয়ারিতেই বাংলা ভাষার অধিকার আদায় করে নিয়েছিল ‘বাংলা মায়ের’ আরও অনেক ছেলেরা।
আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি তার ১০৫তম জন্মদিন। বলছি শাহ আবদুল করিমের কথা। পুঁজি আর সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের যুগে তার জন্ম। লালন-হাসন-রাধারমনের যুগে এত এত টিভি ক্যামেরা, মিডিয়ার ম্যানিপুলেশন, আর পুরস্কারের জৌলুস ছিল না। ছিল না রক, ব্যান্ড, ফিউশন, রিমিক্সের বাহার। আবদুল করিমের যুগে এসে এসব কিছুরই রমরমা অবস্থা। তবু এই অস্থির, ব্যস্ত, প্রদর্শনবাদী নগরায়নের যুগে এসেও এক আশ্চর্য অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে গেছেন শাহ আবদুল করিম।
আকাশচুম্বী খ্যাতি, কিংবদন্তি অভিধা আর নানা প্রলোভনও তাকে সামান্যতম বিচলিত করতে পারেনি। কত শত পদক আর সম্মাননা পেয়েছেন। নাগরিক নানা বিউটি পার্লারেও ঢোকানো হয়েছে তাকে। কিন্তু তাতে বদলানো যায়নি এই বাউলের চেহারা।
সবকিছুকে উপেক্ষা করে আবার তিনি ফিরে গেছেন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের কালনীর তীরে; তার উজানধলে, ভাঙা কুঠিরে। যেখানে চিরনিদ্রায় আছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা কিংবা বলা যেতে পারে ‘বাউল সম্রাটের’ জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সরলা। তাই তো স্ত্রীর পাশেই চিরনিদ্রায় ডুবেছেন আবদুল করিম।
বাউল আর বাউলপনা যখন সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষুর কোপানলে পড়ছে অহর্নিশ, আবদুল করিম তখন আত্মবিশ্বাস ও সাহসের সঙ্গে নিজেকে বাউল হিসেবে প্রচার করলেন। লালনরা লিখেছেন, ‘আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয়’, কিংবা ‘ভাইবে রাধারমন বলে’, তখন আবদুল করিম এসে লিখলেন, ‘বাউল আবদুল করিম বলে’ কিংবা ‘বাউল আবদুল করিম গায়’। তখনই প্রথম আমরা কোনো বাউলের মুখে নিজেকে বাউল হিসেবে দাবি করতে শুনি।
তিনি ছিলেন রাখালবালক। স্কুলে কয়েক দিন মাত্র গিয়েছেন। সারা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী। তবু গান ছাড়েননি বাউল করিম। বরং এইসব প্রতিকূলতা তাকে আরও দৃঢ়চেতা করেছে।
গানের জন্য তাকে ধর্মজীবীরা একঘরে করেছে, স্ত্রী সরলা ও শিষ্য আকবরের জানাজায় অংশ নেয়নি এলাকাবাসী। তবু করিমকে টলানো যায়নি।
বাউল করিমের এই স্কেচ করেছেন শাহ আলম
কবি টি এম আহমেদ কায়সারকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কখোনই আসমানি খোদাকে মান্য করি না... প্রচলিত ধর্ম ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ তৈরি করে দিয়েছে। মোল্লাদের কায়কারবার দেখলে মনে হয় একাই আবার যুদ্ধ করি। একাই আবার লড়াইয়ের ময়দানে নামি, জীবনের ভয় আর করি না।’
শাহ আবদুল করিম শুধুমাত্র বাউল ছিলেন না, তিনি একাধারে গণসঙ্গীত শিল্পীও। সারা জীবন শোষিত বঞ্চিতদের পক্ষে গান লিখেছেন।
যেমন তিনি লিখেছেন, ‘মন মজালে অরে বাউলা গান।’ ভালো কথা। বাউলের মন তো বাউলা গান মজবেই। অথচ এই গানের শেষে এসে বলছেন, ‘তত্ত্বগান গেয়ে গেলেন যারা মরমী কবি/ আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি/ বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তি বিধান।’
তার লেখার এমন আরও কিছু উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন, ‘শোষিত বাঙালি আর ভুলবে না কখন/ এই দেশে শাসনের নামে চলবে না শোষণ।’
গেয়েছেন, ‘ভোট দিবায় আজ কারে?/ ভোট শিকারী দল এসেছে নানা রঙ্গ ধরে/... কেউ দিতাছে ধর্মের দোহাই, কেউ বলে গরিবের ভাই/ আসলে গরিবের কেউ নাই, গরীব ঠেকছে ফেরে।’
কিংবা, ‘মনে মনে চিন্তা করি রাজনীতি নয় দোকানদারি/ স্বার্থ মারামারি ধর্ম ধর্ম সব গেছে/ বাউল করিমের বাণী শোনেন যত জ্ঞানীগুনি/ মনে মনে আমি গুনি সর্ষেতে ভূত পাইছে।’
আবদুল করিমের একটি বক্তব্য শুনলেই তার দর্শন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বেহেশত, দোজখ চাই না। জীবিত অবস্থায় আমার ভাটি অঞ্চলের বিপন্ন মানুষের সুখ দেখতে চাই। ওই মানুষগুলোর সুখ যারা কেড়ে নিয়েছে আমার লড়াই তাদের বিরুদ্ধে।
‘একসময় তত্ত্ব সাধনা করতাম, এখন দেখি তত্ত্ব নয়, নিঃস্ব-বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব আর সোনার বাংলা সোনার বাংলা করলে হবে না। লোভী, শোষক, পাপাত্মাদের আঘাত করতে হবে।’
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাউল করিম। তার মৃত্যুতে বাউল ধারার সবশেষ প্রজন্মের উজ্জ্বলতম বাতিটি নিভে যায়। এখন তো ‘বাউল’ তৈরি করে দিচ্ছে রিয়েলিটি শো!
তবে মৃত্যু আবদুল করিমকে অমরত্ব দিয়েছে। ফলে মৃত্যুর এক যুগ পরও বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতাদের কাছে সমান জনপ্রিয় তিনি।
গ্রাম থেকে শহর, রাবীন্দ্রিক পৌঢ় থেকে রক যুগের তরুণ- সবার কাছেই প্রিয় করিমের গান। শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বাঙালির সকল উৎসবে আয়োজনে উপস্থিত থাকেন করিম।
সাধারণ মানুষ প্রিয় বাউলকে মনে রাখলেও করিমকে দেয়া কথা রাখেননি কর্তাব্যক্তিরা।
এ নিয়ে ক্ষুব্ধ শাহ আবদুল করিমের জীবনীকার ও লোকসংস্কৃতি গবেষক সুমনকুমার দাশ। তিনি বলেন, ‘শাহ আবদুল করিম যদিও তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন, কিন্তু সরকারি উদ্যোগে তার স্মৃতি ধরে রাখতে এখনও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, দিরাইয়ের উজানদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি করিমের নামে নামকরণ করার দাবি উঠেছিল। এই বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। কিন্তু সে দাবিও অদ্যাবধি পুরণ হয়নি।’
বাউল করিমের এই স্কেচটিও শাহ আলমের।
মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তার নামে সুনামগঞ্জ শহরে তোড়ন নির্মাণ করা হবে। সড়ক ও মিলনায়তনের নামকরণ করা হবে। অথচ তার মৃত্যুর এক যুগ পেরোলেও এসব প্রতিশ্রুতি ও দাবির কিছুই পূরণ হয়নি।
পরিবার ও ভক্ত-স্বজনদের উদ্যোগে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উজানদল গ্রামে আবদুল করিমের নিজ বাড়ি ও সমাধিস্থল সংরক্ষণ এবং একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। অর্থাভাবে থেমে গেছে সে উদ্যোগও।
সুমন বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে করিম গান গেয়ে গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন জনসভায় করিম গান গেয়েছেন। তার গানে প্রেরণা পেয়েছেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। শাহ আবদুল করিমকে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা উচিত। এতে রাষ্ট্রই দায়মুক্ত হবে।’
শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্রের সম্পাদক কবি শুভেন্দু ইমাম বলেন, ‘অন্তত একটি স্থাপনা বা সড়কের নামকরণ তার নামে তো হতেই পারত। এজন্য তো অর্থের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন সদিচ্ছার। কিন্তু এই সদিচ্ছাটুকু আজ পর্যন্ত তার প্রতি দেখানো হয়নি।’
শাহ আবদুল করিমকে ভালোবেসে ‘বাউল সম্রাট’ নামে অভিহিত করেছেন ভক্ত-অনুরাগীরা। কে কবে প্রথম তাকে এই উপাধি দিয়েছিল তা জানা যায় না। তবে তিনি আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন বাংলার মাটির গান, গ্রামীণ জনপদ, সেখানকার খেটে খাওয়া মানুষ, যারা দেশ ও দশের পেটে প্রতি মুহূর্তে অন্ন যোগায়, তাদের কষ্ট, মান-অভিমান, ভালোবাসা ও বেঁচে থাকার সুরের সম্রাট।
কোথাও স্মৃতিচিহ্ন থাকুক বা না থাকুক, আবদুল করিম তার গান ও সুরের জন্য সম্রাট থেকে যাবেন চিরকাল।