বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যে কারণে বিটিএস এ বছরও সেরা

  •    
  • ২৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ২০:৫২

সেরা অ্যালবাম। সেরা গান। সবচেয়ে বড় ভার্চুয়াল শো, যার টিকেট বিক্রি হয়েছে ১০ লাখ। করোনার কালে কোরিয়ান মিউজিক ব্যান্ড বিটিএস যা অর্জন করেছে, তা আর কারো পক্ষে করা সম্ভব হয়নি।

অক্টোবরের শেষ সময়ে, সোফায় বসে সুগা গিটারে সুর তুলছে। খালি পা। চোখের উপর লম্বা সরু চুলগুলো এসে পড়ছে। গিটারের কর্ডগুলো পরীক্ষা করতে করতে নিজের মনে কথা বলছে, কানের রুপালি দুল সূর্যের আলোয় ঝলকানি দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

‘আমি কয়েক মাস আগেই শিখতে শুরু করেছি।’-বললেন সুগা। ‘এটা খুব আন্তরিক একটা মুহূর্ত, যেমন মুহূর্ত আপনি পার করেন কলেজের ডর্মরুমে, কাছের মানুষটার সঙ্গে রকস্টার হওয়ার স্বপ্ন ভাগাভাগি করে নেয়ার সময়।’

কোরিয়ান পপ ব্যান্ড বিটিএস-এর সাত সদস্যের মধ্যে একজন সুগা। তাদের জনপ্রিয়তার কথা বোঝাতে তিনি বললেন, ‘লাখ লাখ ভক্ত যারা আমাদের দেখেন, তাদের মধ্যে আমি মাত্র একজন।’

বিটিএস শুধু সেরা গানগুলোর চার্টে কে-পপের প্রতিনিধি নয়, দিনে দিনে তারা পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ডে। কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ করে, মিউজিক বিষয়ক সব ধরনের রেকর্ড ভেঙ্গে এবং ২০২০ সাল জুড়ে আকস্মিক কিছু লাইভ অনুষ্ঠান করে পপ সংগীত জগতের জনপ্রিয়তার চূড়ায় আছে বিটিএস। এ সব কিছু তারা অর্জন করেছে একটি মাত্র বছরে, যে বছর সবাই একটা দীর্ঘ বিরতির মধ্য দিয়ে পার করেছে, নিজেদের মধ্যে সংযোগ হারিয়েছে।

বিটিএস ব্যান্ড

অন্য তারকারা যেখানে নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, সে সময়ও, ‘দ্য আর্মি’ নামে পরিচিত বিটিএসের আন্তর্জাতিক ভক্তরা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সুগা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাগাজিন টাইমকে বলেন, ‘মাঝে মধ্যে আমি পেছনে ফিরে যাই এবং অবিশ্বাস্য কিছু মুহূর্তের কথা ভাবি। কিন্তু এর ঠিক পরেই আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরা যদি কাজটা না করতাম, তাহলে আর কে করত?’

বিটিএস আজ একটি মাল্টিবিলিয়ন-ডলার ব্যবসা। কয়েক দশক ধরে সংগীত জগতের রক্ষীরা যেমন, পশ্চিমা রেডিও জগতের মুঘল, মিডিয়া জগতের মানুষ ও যারা এসব সংখ্যার হিসেব রাখে, তারা এ বিষয়টিকে অভিনব ঘটনা হিসেবে দেখছে।

কোরিয়ান পপ সংগীত বা কে-পপের ঐতিহ্য অনুসরণ করে বিটিএস তাদের যাত্রা শুরু করে। অর্থাৎ আকর্ষণীয় পোশাক, মন মাতানো নাচ এবং চকচকে ভিডিও। কিন্তু চাকচিক্য তারকা জীবনের পাশাপাশি ভক্তদের সামনে তারা তাদের কঠিন পরিশ্রমের গল্পগুলোও ভাগ করে নিয়েছে।

সুগা, জিন ও আরএম

বিটিএস-এর গানগুলো যে কোনো ধরনের প্লে লিস্টের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। প্রাচ্যের ব্যান্ডগুলোর মধ্যে বিটিএস একমাত্র ব্যান্ড নয়, যারা তাদের জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে।

তবে তারা আলাদা কেন? কারণ ভক্তদের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখতে হয় এবং মিউজিককে কীভাবে গ্রহণ করতে হয়, তাতে এক সমুদ্র পরিমাণ পরিবর্তন এনে তারা এ সাফল্য পেয়েছে। ভক্তরা ৭.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের শেয়ারে তাদের অ্যালবামগুলো কিনে নেয় যা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ প্রতিবাদে বিটিএসের দশ লাখ ডলার অনুদানের সঙ্গে যোগ হয়।

সংগীত জগতের ইতিহাসে বিটিএস মানব সম্পর্কের জন্য একটি শিক্ষণীয় অংশ হয়ে থাকবে। সুগা একবার গিটার রপ্ত করে ফেললে তাদের জন্য জয় করার আর কিছুই বাকি থাকবে না।

ভিন্ন এক জগতে যেখানে কোভিড-১৯ এর অস্তিত্ব নেই, সেখানে বিটিএসের এই বছরটা হয়তো অন্য বছরগুলোর মতোই হতো। দলটি তাদের যাত্রা শুরু করে ২০১০ সালে। কে-পপ ব্যান্ডগুলোর পেছনের মানুষ ও বিগ হিট এন্টারটেইনমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা বাং সি-হাইউক সিউলের আন্ডারগ্রাউন্ড র‍্যাপ থেকে আবিষ্কার করেন ২৬ বছর বয়সী র‍্যাপার আরএমকে। এরপর তার সঙ্গে যোগ দেন ২৮ বছরের জিন, ২৭ বছরের সুগা, ২৬ বছরের জে-হোপ, ২৫ বছরের জিমিন, ২৪ বছরের ভি ও ২৩ বছরের জুং কুক। তাদের নির্বাচন করা হয় নাচ, র‍্যাপ ও গানের ভিত্তিতে।

বিটিএসের সহকর্মীদের থেকে তাদের শিল্পচর্চার ধরন ভিন্ন। সমাজে যে প্রচলিত ধারণাগুলো আছে, তার বিপরীতে অবস্থান নেয় বিটিএস। এসব চিন্তা-ভাবনা উঠে আসে তাদের কথায়, কাজে, গানে ও সুরে। কে-পপ মিউজিক জগতে বিটিএস আসার আগে এ ধারণা ছিল বিরল। কিন্তু এখন তা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে।

২০১৩ সালে প্রকাশিত তাদের প্রথম গান ‘নো মোর ড্রিম’ এ তারা কোরিয়ার সামাজিক কিছু প্রচলনের সমালোচনা করে। যেমন, স্কুলপড়ুয়া শিশুদের কাছ থেকে অভিভাবকদের উচ্চাশা। তারা খোলাখোলিভাবে নিজেদের মানসিক দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলেছে সবার সামনে। এটাও জানিয়েছে, তারা এলজিবিটিকিউ অধিকারের পক্ষে। ভক্তদের সামনে নিজেদের প্রকাশ করার সময়েও তাদের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। সমাজে পুরুষত্বের যে চিহ্নগুলো প্রচলিত, তা থেকে বেরিয়ে আসে বিটিএসের প্রতিটি সদস্য। চুলে পোলাপী বা নীল রঙে মানা নেই তাদের, একে অপরকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে যে সহজাত আনন্দ, তাও ফুটে ওঠে তাদের চেহারায়। এ সব কিছুই তাদের আলাদা করে রেখেছে, শুধু কে-পপ জগতেই নয়, বরং সারা বিশ্বে।

ভি ও জিমিন

মার্চে এ ব্যান্ডটির ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যাওয়ার কথা ছিল। করোনা মহামারির কারণে তারা এটি স্থগিত করে। সিউলেই থেকে যায়। দলের সদস্যদের মতে, এই লকডাউন তাদের জন্য ভিন্ন কিছু ছিল না।

ব্যান্ডের আরেক সদস্য জিন বলেন, ‘মাসের ৩০ দিন প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে আমরা একসঙ্গে কাটাই।’

এবার আগস্টে তারা প্রথমবারের মতো ইংরেজি ভাষায় গান প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ডায়নামাইট। এ গানটি কোরিয়ান গান হিসেবে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের গানের তালিকার শীর্ষে অবস্থান নেয়।

তাদের নতুন অ্যালবাম বি একই সপ্তাহে বিলবোর্ডের সেরা অ্যালবামের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে। এরই মাধ্যমে তারা সংগীত জগতের ইতিহাসে রেকর্ড করেছে। বিটিএস একমাত্র ব্যান্ড যারা একই সময়ে বিলবোর্ডের সেরা গান ও সেরা অ্যালবামের তালিকার শীর্ষে ছিল।

বর্তমানে ডাইনামাইট গানটি রয়েছে ২৪ নম্বরে।

বিটিএস সদস্য আরএম বলেন, ‘আমরা ভাবিনি যে আমরা আরও একটি অ্যালবাম বের করব। জীবন আসলে ভারসাম্য করেই চলে।’

এ বছরটি বিটিএসের জন্য শুধুই যে গানের দিক থেকে সফল তা নয়। অক্টোবরে তারা সময়ের সবচেয়ে বড় ভার্চুয়াল শো আয়োজন করে ১০ লাখ টিকিট বিক্রি করে।

তাদের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সামনে আসে এবং এর প্রতিষ্ঠাতা বাং একজন বিলিওনেয়ার। ব্যান্ডের প্রতিটি সদস্যকে তারা মিলিওনিয়ারে পরিণত করে। তাদের পুরষ্কৃত করা হয় গ্র্যামি মনোনয়নের মাধ্যমে।

ইউটিউবে বিগ হিট লেবেলের চ্যানেল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সাবস্ক্রাইব করা ১০টি চ্যানেলের মধ্যে একটি। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই তারা ১৩ মিলিয়নের বেশি ভিউ পেয়েছে।

ইউটিউবের ট্রেন্ড ব্যবস্থাপক কেভিন মিনানের মতে, তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী তারা নিজেরাই। ‘ডাইনামাইট’ গান প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা ১০১ মিলিয়ন ভিউ হয় ইউটিউবে, যা ইউটিউবের ইতিহাসে প্রথম। কেভিন বলেন, ‘তারা তাদের নিজেদের সব রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলছে।’

জুংকুক ও জে-হোপ

গৌরব যে একা আসে তা নয়, সঙ্গে অনেক কিছু নিয়েও যায়। যেমন, অবসর। নভেম্বরের শেষের দিকে প্রায় মধ্যরাতেও সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন সুগা। কিছুদিন আগেই তার কাঁধের অপারেশন হয়েছে।

সামনে জিনের জন্মদিনের কথা উঠলেই ভি, জিমিন ও জে-হোপ উচ্চস্বরে গান শুরু করছে। বিটলসের লাভ লাভ লাভ গানের উপযুক্ত ব্যবহার করে জিনের দিকে ফিরে গান গাচ্ছে ও আঙ্গুল দিয়ে হৃদয়ের আকার দেখাচ্ছে।

বিটলসের মতো ব্যান্ড যারা পুরো একটা সময়কে সংজ্ঞায়িত করে, তাদের সঙ্গে বিটিএসের তুলনা হয়েই যায়। উত্তরে ভি বলেন, ‘পার্থক্য শুধু এখানেই যে, আমরা সাতজন ও আমরা নাচ করি। এটা এখন প্রচলিত হয়ে গিয়েছে, যখন ছেলেদের কোনো ব্যান্ড আসে, তখন সবাই বলে, এই আরেকটা বিটলস এলো।’

টাইম-এর প্রতিবেদক বলেন, বিটিএসের সাক্ষাৎকার তিনি পাঁচ বার নিয়েছেন। এটির সদস্যরা প্রত্যেকেই স্বভাবত ভদ্র। আরএম মনে করেন, তাদের সাফল্য ভাগ্য, সঠিকতা আর ইচ্ছার উপর তৈরি হয়েছে। পরমুহূর্তেই বলে ওঠেন, ‘আমি শতভাগ নিশ্চিত নই।’

তারা দিন দিন আরও পরিণত তারকায় রূপ নিচ্ছে, নিজেদের লক্ষ্যের ব্যাপারে সতর্ক। বড় প্রশ্নের জন্য সবসময় প্রস্তুত, এবং ভারি কোনো জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে ইতস্তত।

বিটিএসের সফলতম বছর সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞেস করা হলে জে-হোপ বলে ওঠেন, ‘রোলার-কোস্টার’, আরএম বলেন, ‘খারাপ কিছু ঘটবেই কিন্তু তা ধরে রাখা চলবে না।’

জিমিন বলেন, ‘এটা এমন একটা বছর ছিল, যেখানে আমরা প্রত্যেকে যুদ্ধ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে আমরা অনেক ভালো আছি, কারণ সংখ্যাই তা বলে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে।’

বিটিএসের মতো ব্যান্ড যাদের উদ্দেশ্যই ফ্যানদের সঙ্গে থাকা, তাদের জন্য মানুষের সংস্পর্শে না থাকাটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি তৈরি করে। তারপরেও তারা এ পরিস্থিতিকে আশানুরূপভাবে দেখাতে সফল হয়েছে।

জে-হোপ বলেন, ‘আমি সবসময় এমন একজন শিল্পী হতে চেয়েছি যে তার কাজের মাধ্যমে মানুষকে স্বস্তি, আরাম ও ইতিবাচক শক্তি দেবে। আমাদের প্রত্যেকেরই এমন চিন্তাভাবনাই আমাদের পরিচয় দিয়েছে।’

কোরিয়ান দার্শনিক ও লেখক ডক্টর জিয়ং লি বিটিএসের ভক্তদের আবেগকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘হরাইজন্টালিটি’ বলে। সমান্তরালতা, যেখানে শিল্পী ও ভক্তের মধ্যে সমান আদান-প্রদান বিদ্যমান।

জে-হোপ বলেন, ‘আমাদের ওপর আমাদের ভক্তদের এবং ভক্তদের ওপর আমাদের প্রভাব অনেক বেশি। গান তৈরি করার পর আমরা ভক্তদের থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাই, তা থেকে আমরা শিক্ষা নেই।’

বিটিএসের ভক্তরা শুধু যে তাদেরকে প্রথম অবস্থানে নিয়ে গিয়েছে তা নয়, বরং, তাদের ইতিবাচক বার্তা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে।

‘বিটিএস ও এর আর্মি পুরো একটা যুগের চেতনাকে বদলে দিয়েছে, এটা শুধুই এক প্রজন্মের পরিবর্তন নয়,’ বলেন লি।

বিটিএস বিশ্বজুড়ে তরুণদের সক্রিয়তার প্রতীক। এ পরিবর্তন দেখা দেয় যখন ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্রতিবাদে তারা ১০ লাখ ডলার অনুদান দেয়। এছাড়াও জাতিসংঘ ও বিভিন্ন বিদ্যালয়কে সাহায্য করার কাজও তারা দীর্ঘ সময় ধরে করে আসছে।

এখন মানবাধিকার রক্ষা করার সময়। জিন বলেন, ‘সেটা রাজনীতি ছিল না। সেটা বর্ণবাদের সঙ্গে যুক্ত ঘটনা ছিল। আমার মনে করি সবাই সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এ কারণেই আমরা সে সিদ্ধান্ত নেই।’

এ বিভাগের আরো খবর