বিটলস ও জন লেনন মিউজিকের ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য দুটি নাম। ১৯৬০-১৯৭০, দশ বছরের যাত্রা এই পৃথিবীখ্যাত রক ব্যান্ড ও এর প্রতিষ্ঠাতা লিড ভোকালিস্টের। কিন্তু এই অল্প সময়েই ইতিহাসের সেরা রক ব্যান্ড ও মিউজিক আইকনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিটলস ও জন লেনন।
ব্যান্ড ভেঙে যাওয়ার দশ বছর পর বিটলসের এক ক্ষুব্ধ ভক্তের হাতে খুন হন লেনন। নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটনের নিজ অ্যাপার্টমেন্ট ডাকোটার সামনে ৮ ডিসেম্বর ১৯৮০ খুন হন তিনি।
১৯৬৬ সালে লন্ডনের পত্রিকা দ্য ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জন লেনন দাবি করেছিলেন, তারা ঈশ্বরের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এই মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সাক্ষাৎকারটি যখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশ করা হয়, তখন আমেরিকার খ্রিস্টান সম্প্রদায় তাকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে।
এ ঘটনা প্রভাব ফেলে বিটলসের আমেরিকান ভক্ত চ্যাপম্যানের উপরেও। লেননের ঈশ্বরের উপর অবিশ্বাস তাকে কষ্ট দিয়েছিল।
এর মধ্যেই চ্যাপম্যান জে ডি স্যালিঙ্গারের উপন্যাস দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই পড়েন। সমাজের উঁচু স্তরের কোনো ব্যক্তির জীবনযাত্রার প্রতি সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে যে হতাশা তৈরি হয়, তাই এ গল্পের বিষয়বস্তু। এই চিন্তা ডেভিড চ্যাপম্যানকে আকৃষ্ট করে। এ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লেননকে খুন করার পরিকল্পনা করেন।
দ্য বিটলস ব্যান্ডের সদস্যরা
জন লেননের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিবিসির সাংবাদিক টম ব্রুক এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন জন লেননের মৃত্যুর সময়কার অভিজ্ঞতা। তিনি একমাত্র ব্রিটিশ সাংবাদিক, যিনি প্রথম ম্যানহ্যাটনের ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সরাসরি জন লেননের মৃত্যু নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন।
তার প্রতিবেদনটি নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হলো:
নিউ ইয়র্কবাসের প্রতিটি দিনই জন লেননের জীবন আর মৃত্যুর কথা আমার মনে পড়ে।
নিউ ইয়র্কের ডাকোটা বিল্ডিং
ডাকোটা বিল্ডিং থেকে আমি মাত্র চার ব্লক দূরে থাকি। প্রতিদিন আমি বিল্ডিংটা পার হই। জন লেননকে খুন করার আগের রাতে লেননের খুনি মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান তার জীবনের প্রথম রাত কাটান নিউ ইয়র্ক শহরে, ওয়েস্ট সিক্সটি-থ্রি স্ট্রিটের একটি হোটেলে, যেখানে আমার জিম অবস্থিত।
জন লেনন আমার ক্যারিয়ারকেও বদলে দিয়েছে। ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে আমি ৪০ বছরের বেশি সময় কাজ করেছি। বিবিসির জন্য তিন হাজারের বেশি প্রতিবেদন করেছি। সেই সঙ্গে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় তারকাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। কিন্তু আমার সঙ্গে যখন কারো দেখা হয়, তারা আমার কাছে একটা কথাই জানতে চান: জন লেননের মৃত্যু নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
আমাকে মানতেই হবে এটা একটা বড় ঘটনা। কিন্তু এ ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করা সহজ ছিল। ডাকোটার সামনের এক টেলিফোন বুথ থেকে লন্ডনের ‘বিবিসি রেডিও ফোর’-এর প্রেজেন্টার ব্রায়ান রেডহেডকে আমি নিয়মিত ঘটনাস্থল থেকে খবর দিচ্ছিলাম।
ভবনের সামনের রাস্তায় সমাবেত শত শত লেনন ভক্তদের মধ্যে থেকে কারো কারো সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম।
আমার আশেপাশের সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ছিল, ভক্তদের কেউ কেউ আর্তনাদ করছিল। আমি নিজে লেননের অনুসারী ছিলাম।
সেদিন বিবিসির দেয়া আমার প্রথম আইডি কার্ডে নিজের ছবিটা দেখছিলাম- ভয়ংকর। আমি অবাক হই যে বিবিসি কীভাবে আমাকে চাকরিটা তখন দিয়েছিল।
জন লেননের ভক্তের মতোই আমাকে দেখাচ্ছিল। হ্যাঁ, আমি মানসিকভাবে সে রাতে বিপর্যস্ত ছিলাম। কিন্তু সেই শোক দেখানোর অবস্থায় আমি ছিলাম না।
মানুষ আমাকে সবসময় জিজ্ঞেস করে জন লেননের মৃত্যুর পরপরই ডাকোটায় উপস্থিত থাকার অনুভূতি কী। এক জন তরুণীর কথা আমি কখনোই ভুলব না, তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার পেটে খুব জোরে আঘাত করেছে।’
আমার অনুভূতিও ঠিক তাই ছিল।
জন লেনন ও তার স্ত্রী ইয়োকো ওনো
লেননের মৃত্যুর দুই বছর পর আমি ডাকোটায় ফিরে যাই ইয়োকো ওনোর সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। লেননকে নিয়ে কথা বলার সময় এখনও তিনি বর্তমান কাল ব্যবহার করেন।
তিনি আমাকে বলেন, ‘সে এখনও জীবিত, সে এখনও আমাদের সঙ্গে আছে, তার আত্মা সবসময় থাকবে, একটা মানুষকে মেরে ফেলা এত সহজ না।’
লেননের মৃত্যুর ৪০ বছর পরেও লাখ লাখ তরুণ মিউজিশিয়ানের গানের কথায়, সুরে ও গানের ধরনে তার আত্মা এখনও জীবিত আছে।
তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এমন কিছু তরুণের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম। তারা আমাকে বলে, লেননের গান, গানের কথা, তার নিজস্ব ভাবাদর্শ তাদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। তারা এটাও মনে করে, এই মহামারির সময়ে লেননের গান কিছুটা হলেও তাদেরকে স্বস্তি দিয়েছে।
লেননের স্বভাবে অনেক নেতিবাচক দিক ছিল, তিনি নিজে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি নারী নির্যাতন করেছেন। কিন্তু এসব কিছুই তার জনপ্রিয়তা কমাতে পারেনি। বরং তার মৃত্যুর পর দিন দিন তার ভাস্কর্যের সংখ্যা বেড়েছে।
আমার কাছে লেননের সবচেয়ে ভালো লাগে তার কণ্ঠ, শুধু গানের জন্য নয়। তিনি অনেক বিতর্কিত কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি কখনও ভান করেননি– তিনি সবসময় তার নিজস্বতাকে ধারণ করেছেন।
২০ শতকের পপ সংগীতের জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি একজন, সত্যিকারের একজন ব্রিটিশ। তার মৃত্যুর ৪০ বছর পরেও তিনি আমাকে মুগ্ধ করেন।