মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের ডিজিটাল ফরম্যাট তৈরির কাজ করছে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে নিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র ৩৫ মিমি ফরম্যাটে শ্যুট করা।
বাংলাদেশে ডিজিটাল ফরম্যাটে সিনেমা বানানো শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকে। তারেক মাসুদের অন্তর্যাত্রা সিনেমাটি প্রথম ডিজিটালে শ্যুট করা হয়।
সাধারণ দর্শকের কাছে সিনেমা দেখার এখন একমাত্র উপায় ডিজিটাল ফরম্যাট। বর্তমানে পুরনো সিনেমা সংরক্ষণের উপায়ও হলো ডিজিটাল ফরম্যাট।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ সেই পুরনো ফরম্যাটের ছবিগুলোকে ডিজিটাল বানানোর কাজ করছে। ২০১৮ সাল থেকে ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ভবনের কার্যক্রম শুরু হয়।
বর্তমানে ১ হাজার ১৩৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ১১৬টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ১ হাজার ২৫৪টি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ও ৪৮৮টি সংবাদচিত্রসহ ২ হাজার ৯৯৪টি চলচ্চিত্রের সংগ্রহ রয়েছে আর্কাইভে।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ফিল্ম অফিসার ফারুক আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এই মুহূর্তে বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আছে। -৮, -৪, ০, +৮, +৪ ও +১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সংবলিত ছয়টি অত্যাধুনিক ভল্টে আমরা সিনেমা সংরক্ষণ করি।’
‘আমাদের কার্যক্রমের মধ্যে এই মুহূর্তে প্রাধান্য পাচ্ছে জাতির পিতার সাথে সম্পর্কিত সকল চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র, সংবাদচিত্রগুলো। পরের ধাপেই মুক্তিযুদ্ধনির্ভর চলচ্চিত্রগুলোর কাজ শেষ করা হবে। তবে এর মধ্যে অনেকগুলোর ডিজিটাল করার কাজ হয়ে গেছে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে চলচ্চিত্রে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। পরিচালক ফখরুল আলম নির্মাণ করেন ‘জয় বাংলা’ চলচ্চিত্র। ওই সময়ের হিসেবে এই দুইটি সিনেমাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কয়েকজন সাধারণ বাঙালি পরিবারের নারী আর একটি চাবির গোছাকে নিয়ে গল্পকে মনে হতে পারে একটি সাদামাটা পরিবারের গল্প। সে গল্পও যে হয়ে উঠতে পারে একটি রাষ্ট্রের গল্প, সেটি জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্র প্রমাণ করেছে।
১৯৭০ সালে ছবিটি নির্মাণ করেন জহির রায়হান। একটি পরাধীন দেশ কীভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, এটি সেই গল্প। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ছবিটি নির্মাণ ও মুক্তি দুটোই হয়েছে পরাধীন সময়ে।
‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে ফখরুল আলম নির্মিত জয় বাংলা ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছবিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে প্রকাশ করে এমন ছয়টি গল্প। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি প্রথম এই সিনেমাতেই ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী সময়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধেই এই গান বাঙালিকে উজ্জীবিত করে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ১১ আগস্ট ১৯৭২ সালে প্রথম ওরা ১১ জন সিনেমাটি মুক্তি পায়। নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম চলচ্চিত্রটিতে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। একই বছরে মুক্তিযুদ্ধনির্ভর আরও তিনটি সিনেমা মুক্তি পায়। সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, আনন্দ নির্মিত ‘বাঘা বাঙালী’, মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র লিয়ার লেভিন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকান চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন জয় বাঙলা নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তা শেষ করতে পারেন নি। তিনি পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে চিত্রধারণের কাজ করেন। সেগুলো নিয়ে তার চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বিজয় মুহূর্ত আসার আগেই বাংলাদেশ থেকে তাকে চলে যেতে হয়।
অনেক দিন পর তারেক মাসুদ তার কাছ থেকে সেই ফুটেজ সংগ্রহ করেন। সেই ফুটেজের ওপর নির্ভর করে তিনি ১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধনির্ভর প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির গান নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংস্কৃতিকর্মীরা কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করার কাজটি করে গেছেন, সেটি তুলে ধরেছেন। সংস্কৃতিকর্মীরাও যে এক একজন যোদ্ধা ছিলেন, সেটি এই প্রামাণ্যচিত্রটি প্রথমবারের মতো তুলে ধরে।
মুক্তিযুদ্ধনির্ভর চারটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তানভীর মোকাম্মেল। ১৯৯১ সালে স্মৃতি একাত্তর, ১৯৯৫ সালে নদীর নাম মধুমতী’, ২০০৮ সালে রাবেয়া ও ২০১৪ সালে জীবনঢুলী।
তানভীর মোকাম্মেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ আমাকে সবসময়ই তাড়িত করেছে। একটি জাতির সাথে মাত্র নয় মাসে এত কিছু ঘটে যেতে পারে, এইটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শুধু মুক্তিযুদ্ধই নয়, সেই দেশভাগের সময় থেকে এ দেশের মানুষের সাথে যা যা ঘটে এসেছে, আমি সবকিছুকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখি।
‘আমার ছোটবেলায় খুলনায় যখন আমি বড় হয়েছি, তখন থেকে আমি দেখেছি ধর্মের কারণে দেশভাগ মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করে। আমার একের পর এক অমুসলিম বন্ধু দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। সেইগুলো আমার মনে বিশাল দাগ কাটে। এ কারণেই আমার দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কাজ করা।’
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে মোরশেদুল ইসলাম তিনটি সিনেমা নির্মাণ করেন। ১৯৮৪ সালে আগামী, ২০১১ সালে আমার বন্ধু রাশেদ, ২০১৫ সালে অনিল বাগচীর একদিন।
আমার বন্ধু রাশেদ চলচ্চিত্রটি শিশুতোষ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শিশুদেরকেও যেভাবে উদ্বেলিত করেছিল, সেটি এই চলচ্চিত্রে ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধনির্ভর তার শেষ ছবি অনিল বাগচীর একদিন। তিনি এক মধ্যবয়স্ক যুবকের চোখে একাত্তরকে দেখাতে চেয়েছেন।
সেখানে রং বিন্যাস দিয়ে তিনি চরিত্রের মনস্তত্ত্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সিনেমায় দেখা যায়, একাত্তরের যুদ্ধ শুরুর আগে অনিলের সবকিছু রঙিন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের সময়ে অনিলের সবকিছু সাদা-কালো। এর মাধ্যমে নির্মাতার নির্মাণ কৌশলে প্রেক্ষাপট চিত্রায়িত হয়েছে।
কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোট গল্প ‘রেইনকোট’ অবলম্বনে মেঘমল্লার চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন জাহিদুর রহিম অঞ্জন। সরকারি অনুদানে ২০১৫ সালে সিনেমাটি নির্মিত হয়।
গল্পের মূল চরিত্র নূরুল হুদা বাংলাদেশের একটি মফস্বল শহরের সরকারি কলেজের রসায়নের শিক্ষক। তিনি সে সময়ের বাঙালি মধ্যবিত্তের শঙ্কা, ভয়, পিছুটানের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদের যে অসহায় সময় পার হয়েছে, সেটি এই চলচ্চিত্র থেকে পরিষ্কার ফুটে ওঠে।