আলী যাকের শারীরিকভাবে আর নেই। তবে তিনি পাঁচ দশকের অভিনয় জগতে যে কাজ করে গেছেন, তার স্মৃতিচারণ করে সহ অভিনেতারা বলেছেন, যাকেরের মতো মানুষ কখনও হারিয়ে যান না। বাংলা নাট্য জগতে তিনি সব সময় বেঁচে থাকবেন তার কাজ দিয়ে।
শুক্রবার সকালে মৃত্যুর পর নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শেষবারের মতো নেয়া হয় নাট্য ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা, মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকেরকে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন, এই তথ্যও নাটকের সঙ্গে জড়িতদেরকে রুখতে পারেনি। ছুটে গেছেন প্রিয় ভাই, সহকর্মী, বন্ধু, সহযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
সবাই বললেন, বাংলা নাটকের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল মানুষটির প্রয়াণে।
সেখানে যাকেরকে বিদায় জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মানে।
প্রখ্যাত অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘যাকের ছিলেন বিশালদেহী, কিন্তু মন ছিল শিশুর মতো। তিনি মানুষকে সাহায্য করতে ভালোবাসতেন। কেবল আর্থিকভাবে নয়, উৎসাহ দিয়েও মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে অবদান রেখেছেন।’
যাকেরের সঙ্গে প্রায় ৫০ বছরের বন্ধুত্ব আর অভিনয় জীবন মামুনুর রশীদের। তিনি বলেন, ‘তিনি অনেক দিন লড়াই করেছেন রোগের সঙ্গে। কোভিড নাইনটিনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আর পারলেন না। যে সমস্ত মানুষ গত হন, কিন্তু বিগত না, সে রকম একজন মানুষ আলী যাকের। তিনি আমাদের নাট্য ইতিহাস থেকে কোনোদিন বিগত হবেন না।’
মামুনুর রশিদ বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, দুই বাংলার নাট্য চর্চায় আলী যাকের যে অবদান রেখেছেন, তা সত্যি অবিস্মরণীয়। তিনি ইংরেজি নাটক ম্যাকবেথ করেছেন, গ্যালিলিও করেছেন। তার যে অসাধারণ নুরুলদীনের চরিত্র, তিনি যে শুয়ে আছেন কফিনে সেটা ভাবতে কষ্ট হয়, বড় কষ্ট হয়।’
স্বাধীনতা উত্তর যে অভিনেতাদের হাত ধরে বাংলাদেশের নাট্য চর্চা এগিয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম আসাদুজ্জামান নূর বললেন, ‘নাট্য চর্চায় আমার ৫০ বছরের জীবনের পথ চলায়, অভিনয়, পারিবারিক বন্ধুত্ব, অভিভাবক হিসেবে যাকে পেয়েছি, তিনি আলী যাকের।’
সাংস্কৃতির ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘আলী যাকের থিয়েটার করতেন। নাট্য দলের বাইরেও তিনি যে নাট্য নির্দেশনা দিয়েছেন, সেগুলো খুবই অসাধারণ। মানুষের সঙ্গে তিনি খুবই স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে মিশতেন। ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন। অভিনয় জীবন, ব্যবসায়িক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন সব দিক থেকেই তিনি সফল।’
সকালে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান ৭৬ বছর বয়সী যাকের। চার বছর ধরে ক্যান্সার, হৃদরোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত গুণি এই অভিনেতার গত সোমবার ধরা পরে করোনাভাইরাস। চার দিনের মাথায় তিনি চলে গেলেন সব মায়া কাটিয়ে।
বেলা ১১টার দিকে আলী যাকেরকে নেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, যে প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণে বহু শ্রম, ঘাম দিয়েছেন তিনি। ছিলেন একজন ট্রাস্টি।
জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক জানান, ১৯৯৫ সালে আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত হন। এই জাদুঘরকে নিয়ে তার পরিকল্পনা ছিল। এটাকে তিনি গণ মানুষের কাছে পৌছে দিতে চাইতেন। যার ফলে এই জাদুঘর একটি বড় জায়গা তৈরি করতে পেরেছে।
অভিনেতা তারেক আনাম খান তুলে ধরেন আলী যাকেরের রাজনৈতিক দীক্ষার বিষয়টি। তিনি বলেন, ‘ভীষণ বন্ধুবৎসল এবং কী বলব, আড্ডাবাজ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যে কারণে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের লোকজনের মানসিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র, এই চারটা মূলনীতিকে আলী যাকের সাহেব বুকের মধ্যে লালন করে গেছেন আমৃত্যু। এর বাইরে তিনি কখনও কিছু করেননি।’
আর কী বলব- এ কথা বলে ঠোঁট কাঁপতে থাকে তারেক আনামের।
১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের রতনপুর ইউনিয়নে জন্ম নেয়া আলী জাকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এ সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দ সৈনিক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি আট নম্বর সেক্টরে করেন যুদ্ধ।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন। ওই বছরের জুনে আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন। ওই দলে তিনি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন, যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ওয়াপদা মিলনায়তনে ।
১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের বাকি ইতিহাস নাটকে, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা।
শিল্পকলায় অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে একুশে পদক ছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদক, অভিনয়ের জন্য দ্য ডেইলি স্টার-স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড সেলিব্রিটিং লাইফ – ২০১৮ মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার -২ পেয়েছেন এই অভিনেতা, নাট্য নির্দেশক।