৪৩ বছরের সংসারের মায়া কাটিয়ে জীবনসঙ্গীকে বিদায় দিতে হচ্ছে সারা যাকেরকে। বিদায় বেলায় অশ্রুভরা চোখে প্রিয় মানুষটির স্মৃতিচারণে আবেগের পাশাপাশি তার রোমান্টিকতা, ছোট ছোট স্বপ্নের বিষয়টি তুলে ধরলেন সারা যাকের।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মহীরুহদের একজন আলী যাকেরের হাতে গড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তার মরদেহ নেয়া হয়েছে শেষ বারের মতো। সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে যান সারা যাকের, যার সঙ্গে প্রাণ বেঁধে স্বপ্ন বুনেছিলেন আলী।
ক্যান্সার, করোনাভাইরাসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে আলী যাকের শুক্রবার ভোরে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান। পরে তার মরদেহ নেয়া হয় আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।
আলী যাকেরের পারিবারিক একটি ছবি। বাবার প্রয়াণের পর ছেলে ইরেশ যাকের ছবিটি শেয়ার করেছেন
সারা যাকের বলেন, ‘তার জীবনযাপন, স্বপ্ন- সবই ছিল মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক ও রোমান্টিক। কখনও এমন স্বপ্ন দেখেননি অনেক দেশ ঘুরবেন, অনেক বড় ফ্ল্যাট করবেন।’
আলী যাকেরকে যে পরিচয়ে কেউ চেনেন না, সেটিও তুলে ধরলেন সারা। তিনি বলেন, ‘যেটা কেউ জানেন না সেটা হচ্ছে তিনি খুব সংসারি ছিলেন। চিন্তা করতেন, ছোট্ট একটা ঘর হবে, ঘরের পাশে বাগান থাকবে, বাগানের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে যাবে।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রিয় মানুষটির স্মৃতিচারণ করছেন ৪৩ বছরের সঙ্গী সারা যাকের
পিতা হিসেবে আলী যাকেরকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সারা বলেন, ‘দেশপ্রেমিক, সংস্কৃতি কর্মী, মঞ্চকর্মী, আমার সহযোদ্ধো ছিলেন আলী যাকের। কাজে, পেশায়, নেশায় একটা মানুষ, শিশুসুলভ একটা মানুষ। আমার বলতেই হয়, শিশুর মতো সরল ছিলেন তিনি। বাবা হিসেবে ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি রাখেননি।’
দেশকে ভালোবাসতেন আলী যাকের। তার জীবনচারণে তা ফুঠে উঠত। নিজের শেকড়ে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা দেখা যেত তার মধ্যে। সারা বলেন, ‘আমার শ্বশুরের কথা চিন্তা করে বাগান করতেন। বাগানের ফুলগুলো, গাছগুলো যত্ন করতেন।’
‘আমার শ্বশুরের কথা মনে করে রতনপুরে ফিরে গিয়ে ঠিক যে বাড়িটা আমার শ্বশুর রেখে এসেছিলেন ২০ বছর আগে, সেটাতে আর হস্তক্ষেপ করেনি। দীঘির উল্টো দিকে আরেকটা বাড়ি করেছে এবং সেই বাড়িতে বছরে চারবার করে যেতেন। লোকটি যে দেশটিকে ভালোবাসত, তার বিভিন্ন আচরণ আমি পেয়েছি তার মধ্যে।’
মুক্তিযুদ্ধের সেনা আলী যাকের ১৯৭২ সালে পা দেন অভিনয় জগতে। ওই বছরের জুনে যোগ দেন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে।
নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের জন্য বিশ্বখ্যাত বিদেশি নাটকের বাংলা রূপান্তর আর নাটক নির্দেশনার ব্যস্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে ওই দলে যোগ দেন সারা যাকের।
সারাকে শুরুতে চোখেই পড়েনি আলী যাকেরের। একটি নাটকের প্রদর্শনীর আগের দিন একজন অভিনেত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে সারাকে দেয়া হয় চরিত্রটিতে অভিনয় করতে। আলী যাকেরের ওপর দায়িত্ব পড়ে চরিত্রটার জন্য তাকে তৈরি করার।
খুব দ্রুত চরিত্রটির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেন সারা যাকের। এই প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে যান আলী যাকের।
এই মুগ্ধতা থেকে প্রণয়, আর প্রণয় থেকে বিয়ে।
১৯৭৭ সালের চার হাত এক হয়। বিয়ে করে সংসার পাতেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা দুই নাট্য অভিনেতা।
এরপর ৪৩ বছর ধরে একে অপরের সুখ দুঃখের সাথি হয়ে থাকা সঙ্গীকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে দেখে বেদনায় বুক ভেঙে যাচ্ছে সারার।
এই দম্পতির দুটি সন্তান। বড় সন্তান ইরেশ যাকের বাবা মায়ের পথ ধরেই একজন অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কন্যা শ্রিয়া সর্বজয়া রেজিও আরজে হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন।