অস্কারজয়ী ইতালিয়ান অভিনেত্রী সোফিয়া লরেনের নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে নেটফ্লিক্সে। ইতালীয় ভাষার সিনেমার নাম দ্য লাইফ আহেড ।
মাঝে ১০ বছরের বিরতি। যে পরিবারের জন্য সিনেমা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন, সেই পরিবারের টানেই আবারো ফিরেছেন রুপালি পর্দায়।
ছোট ছেলে এলডোরাডো পন্টির গল্প ও পরিচালনায় সোফিয়া লরেন অভিনয় করেছেন দ্য লাইফ আহেড-এ।
এলডোরাডোর নির্দেশনায় তৃতীয়বারের মতো অভিনয় করলেন সোফিয়া। দ্য লাইফ আহেড-এ মাদাম রোজা নামের এক চরিত্র সোফিয়ার, যিনি একজন হলোকাস্ট সারভাইবার।
মোমো নামের একজন সেনেগাল অনাথ শিশুকে ঘরে আশ্রয় দেন মাদাম রোজা। গল্পের শুরুতে তাদের মধ্যে দূরত্ব থাকলেও ধীরে ধীরে তৈরি হয় নিবিড় সম্পর্ক।
এই সিনেমা ও নিজের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সোফিয়া লরেন কথা বলেছেন ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্টের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন: ১৯৮০ সাল থেকে আপনি কাজের মাত্রা কমিয়ে আনেন। তখন এলডোরাডোর বয়স সাত ও তার ভাই কার্লো জুনিওরের বয়স ১২। কাজ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণ কী ছিল?
সোফিয়া: সেই সময়ে আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘সোফিয়া, তুমি জীবন থেকে কী চাও?’ উত্তর পেলাম, আমি চাই সুন্দর একটা পরিবার। যেটা তখন আমার ছিল। আমি চাই দুটি সন্তান। সেটাও তখন আমার ছিল। কিন্তু আমি তো ওদের দেখা পাই না।
তখন আমি নিজেকে বললাম, ‘এখন হয়ত সময় এসেছে কিছুটা ধীর স্থির হওয়ার।’ কিন্তু দেখা গেল, আমি ধীর স্থির হওয়ার বদলে কাজ করাই বন্ধ করে দিলাম। কাজের প্রতি ভালোবাসা কমে যায়নি কখনো, তবে আমি আমার পরিবারকে জানতে চেয়েছি, কারণ এর আগে আমি বেশিরভাগ সময় স্টুডিওতেই কাটাতাম।
খুব অবাক হয়েছি যখন আমার মনে এই কথাটা এসেছে, ‘সোফিয়া, এখন অভিনয় করা বন্ধ করে দেয়াটাই তোমার জন্য ভালো। তুমি কিছু পরে আবার ফিরে যেও।’
দীর্ঘ সময় আমি সিনেমায় কাজ করা থেকে দূরে ছিলাম। কিন্তু খুব খুশি ছিলাম যে, আমার সন্তানদের বড় হতে দেখেছি, তাদের বিয়ে দেখেছি, তাদের সন্তানও হতে দেখেছি। (২০০৭ সালে ৫০ বছর বয়সে সোফিয়ার স্বামী কার্লো পন্টি মারা যান।)
দ্য লাইফ আহেড চলচ্চিত্রে মাদাম রোজা চরিত্রে সোফিয়া লরেন
প্রশ্ন: এখন আপনি কোন ধরনের স্ক্রিপ্ট পান?
সোফিয়া: আমি এখনও অনেক স্ক্রিপ্ট পাই কিন্তু কোনটাই দ্য লাইফ আহেড এর মতো আমাকে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেনি। এ কারণে গত ১০ বছর কাজ করিনি। আমি এমন একটা চরিত্রের অপেক্ষায় ছিলাম যেটা আমাকে অনুপ্রাণিত করবে, একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করবে।
মাদাম রোজা এমনই একটা চরিত্র। শুধু তার চরিত্রের বৈচিত্র্যের জন্য নয়; সিনেমাটি সহনশীলতা, ভালোবাসা ও যূথবদ্ধতার যে বার্তা দেয়, সেই বিষয়টা আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
প্রশ্ন: কিছু সময় আপনি নিজেকে একজন ‘পারফেকশনিস্ট’বলে পরিচয় দিয়েছেন। দ্য লাইফ আহেড এলডোরাডোর সঙ্গে আপনার করা তৃতীয় কাজ, তার নির্দেশনায় কাজ করাটা কি আপনার জন্য সহজ?
সোফিয়া: আমার মতো সেও একজন পারফেকশনিস্ট। এলডোরাডো আমাকে নিরাপত্তার অনুভব দেয়। আমি আমার সেরা কাজটা তাকে না দেয়া পর্যন্ত সে হার মানে না। সে খুব ভালো করেই জানে আমার থেকে আমার সেরা কাজটা আদায় করতে হলে তাকে কী করতে হবে।
সিনেমা শুটিংয়ের সময় এলডোরাডো যখন বলে, ‘দিস ইজ ইট’ তখনি আমি বুঝতে পারি- আমার যে অভিনয়ের জন্য সে এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল, সেটা ও পেয়ে গেছে। এটা একজন অভিনেত্রীর জন্য ভীষণ দারুণ, কারণ তখন সে আসলে বুঝতে পারে সে কী করছে।
প্রশ্ন: ভিত্তোরিও দে সিকার মতো পরিচালকের থেকে আপনি কী শিখেছেন?
সোফিয়া: দে সিকা আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে কোনো একটা প্রবণতার পেছনে না দৌড়ে নিজের সহজাত স্বভাবকে অনুসরণ করতে হয়, নিজের প্রতি নিষ্ঠ থাকতে হয়। কোনো কাজ করার চেয়ে বলা সহজ, কিন্তু কাজটি করাই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
১৭ বছর বয়সে দে সিকার সঙ্গে আমার দেখা। (১৯৫৪ সালে দে সিকার পরিচালনায় দ্য গোল্ড অব নেপেলস সিনেমায় অভিনয় করেন) দে সিকা আমার কাছে একজন পবিত্র মানুষ, তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিচালক।
তিনি আমাকে দেখে বলেছিলেন, ‘ওহ তুমি তো নেপলস থেকে এসেছ। তোমার জন্য আমার কাছে কিছু আছে।’ এভাবেই ভিত্তোরিও দে সিকার সঙ্গে সিনেমায় আমার অভিনয় জীবনের শুরু।
প্রশ্ন: বাস্তব জীবনে বা সিনেমা থেকে পরিচয় হওয়া চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ থাকাটা আপনার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সোফিয়া: যুক্তরাষ্ট্রের সিনেমায় কাজ করার সময় এটা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করা আমার জন্য শিক্ষণীয় ছিল, কিন্তু সেটা পুরোপুরি একটা বিদেশি অভিজ্ঞতা।
২২ বছর বয়সে, আমি ক্যারি গ্র্যান্ট ও ফ্র্যাঙ্ক সিনান্ট্রার সঙ্গে কাজ করি, তখনো আমি বাচ্চা। (১৯৫৭ সালে প্রাইড অ্যান্ড প্যাশন সিনেমায়) তখনো আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ইংরেজি ভাষায় কাজ করায় অনেক সুযোগ আছে, এমনকি ভাঙা ইংরেজিতেও তা কাজ করে। যেহেতু ইংরেজি আমার ভাষা নয়।
কিন্তু ইংরেজি ভাষা ও গান আমার খুব ভালো লাগে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই সেটা শিখে ফেলি। ডিজায়ার আন্ডার দ্য এল্মস, হাউজবোট আমার করা পছন্দের ইংরেজি সিনেমা।
প্রশ্ন: সমসাময়িক সিনেমা বা টেলিভিশন কি দেখা হয়?
সোফিয়া: টেলিভিশনে আমি শুধু খবর দেখি। তবে ‘দ্য ক্রাউন’ আমার বেশ ভালো লেগেছে।
প্রশ্ন: আপনার আত্মজীবনী ইয়েস্টারডে, টুডে অ্যান্ড টুমোরো তে আপনি অভিনয় জীবনকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘ইতালিয়ান সিনেমার অসাধারণ সময়কে প্রথম থেকেই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ ও অভিজ্ঞতা হয়েছে’। বর্তমান সময়ের ইতালিয়ান সিনেমা ও পরিচালনা কি আপনাকে আকৃষ্ট করে না?
সোফিয়া: আমি খুব বেশি সিনেমা বা সিরিজ এখন দেখি না। তবে মাত্তেও গারোনে ও পাওলো সরেন্তিনোর কাজ খুব ভালো, এবং তারা দুজনেই নেপলিয়ন!
প্রশ্ন: নিজেকে কি একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করেন?
সোফিয়া: অবশ্যই আমি ধর্মপ্রাণ। চার্চে না গেলেও আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। বাসায় প্রার্থনা করি।
প্রশ্ন: বয়স বেড়ে যাওয়া নিয়ে কি আপনি চিন্তিত?
সোফিয়া: তুমি যদি বয়স বেড়ে যাওয়াকে মেনে নাও আর বর্তমানকে নিয়ে বেঁচে থাকো, তাহলে লাবণ্যের সঙ্গেই তোমার বয়স বাড়বে।
প্রশ্ন: আপনি ড্যানিয়েল ডে-লুইসের দারুণ ভক্ত বলে জানিয়েছিলেন, যার সঙ্গে নাইন-এ কাজ করেছেন। এখন তিনি অবসরে, বর্তমান সময়ে আপনি কোন অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে আপনার পছন্দ?
সোফিয়া: আমি এখনও ড্যানিয়েল ডে-লুইসের ভক্ত, তিনি কাজ করুন বা না-ই করুন। মেরিল স্ট্রিপকেও পছন্দ করি। দারুণ একজন অভিনেত্রী সে।
প্রশ্ন: তরুণ অভিনয় শিল্পীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
সোফিয়া: এখানে বলার মতো বিশেষ কিছু নেই। ভালোলাগা থেকে আপনি অভিনেতা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এমন কিছু করতে হবে যা আপনার মনের গভীর থেকে আসছে। যা আপনি পছন্দ করেন। তবে আপনার মন আপনাকে যা শিখায় তাই করতে হবে, নিজেকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলতে হবে যেখানে আপনি নিজেকে কেবলই একজন অভিনেতা হিসেবে ভাবতে পারেন। তারপরে বুঝতে পারবেন, আপনি উপযুক্ত কিনা। জীবন কেবল একটি মাত্রায় আবদ্ধ নয়; এটি অনেকগুলো মাত্রা এবং কখনও কখনও একসঙ্গে সমস্ত কিছুর যোগফল।
প্রশ্ন: নিজের সিনেমাগুলো আবার দেখেন?
সোফিয়া: আমি নিজেকে খুব কঠোরভাবে বিচারের প্রবণতা রাখি, তাই নিজের চলচ্চিত্রগুলো না দেখাই আমার পক্ষে ভালো। মাঝেমধ্যে দেখি, বিশেষ করে যখন টেলিভিশনে সেগুলো দেখানো হয় বা আমার বাচ্চাদের সঙ্গে, কারণ সম্ভবত তারা দীর্ঘদিন আগের এসব সিনেমা দেখেনি। এবং এত বছর পর সিনেমাগুলো দেখার সময়ে নিজেকে সম্পূর্ণ অন্য কোনো মানুষ বলে মনে হয়। এটা এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আমি খুব পছন্দ করি।
প্রশ্ন: আপনার কোন অভিনয়ের জন্য নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করেন?
সোফিয়া: টু উইমেন এ আমার চরিত্র নিজের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ (১৯৬২ সালে ভিত্তোরিও দে সিকার পরিচালনায় এ সিনেমার জন্য তিনি অস্কার পান), তবে আ স্পেশাল ডে এর চরিত্রও আমার পছন্দের।
এ সব কিছুই সম্ভব হয় যখন ভালো একটা গল্প থাকে, এবং দে সিকার মতো আদর্শ পরিচালক থাকেন। মারচেল্লো মাস্ট্রোয়ান্নি ও দে সিকার সঙ্গে কাজ করে আমি বেশ আনন্দিত।
প্রশ্ন: আপনি কি অভিনয় চালিয়ে যেতে চান?
সোফিয়া: যদি অভিনয় ভালোবাসি, আমি থামব কেন?
সাক্ষাৎকারটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন ক্রিস্টিনা জয়ীতা মুন্সী
আরও পড়ুন: স্বল্প বসনার ছবিতে পোপের ‘লাইক’