সরকারি অনুদান নিয়ে সিনেমা বানাতে দেরি করা বা না বানানোর কারণে মামলা খাওয়ার ক্ষেত্রে টোকন ঠাকুর প্রথম ব্যক্তি নন। এমনকি এ কারণে গ্রেফতারি পরোয়ানাও তার বিরুদ্ধে প্রথম জারি হয়নি।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, টোকন ছাড়াও পাঁচ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় মামলা করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া নির্মাতা জুনায়েদ হালিমের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে মামলা হয়ে পরে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। জুনায়েদ হালিম পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র অনুদান কমিটির সদস্যও হন। কিন্তু এখনও সেই গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে তার বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বেশ কিছু পরিচালক ও প্রযোজককে সরকারি অনুদান দেয়া হয়। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে চারটি চলচ্চিত্রে অনুদান দেয়ার মাধ্যমে এই প্রথার প্রচলন শুরু হয়। মাঝে বেশ কিছু বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৭-০৮ অর্থবছরে আবার অনুদান দেয়া শুরু করে তথ্য মন্ত্রণালয়। উদ্দেশ্য ভালো সিনেমা বানানোয় আর্থিক সহায়তা।
সম্প্রতি কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুরকে অনুদানের অর্থ নিয়ে চলচ্চিত্র না বানানোর অভিযোগে গ্রেফতারের পর অনুদানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
অনুদান দেয়ার ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকে। ২০১২ সালে সেই নীতিমালার সর্বশেষ সংশোধনী হয়।
সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী, অনুদান পাওয়া সব চলচ্চিত্র নির্মাতা তিন কিস্তির মাধ্যমে টাকা পাবেন। প্রথম কিস্তির টাকা পাওয়ার পর নয় মাসের মধ্যে চলচ্চিত্রটি শেষ করার কথা বলা হয়। কিন্তু দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এখন পর্যন্ত অনুদান পাওয়া কোনো নির্মাতাই এই সময়সীমায় চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করতে পারেননি।
কোনো নির্মাতা যদি কোনো কারণে সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারেন, তখন মন্ত্রণালয়ের কী করণীয় থাকে?
নীতিমালায় বলা আছে, বিলম্বের বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানালে মন্ত্রণালয় সেটি বিবেচনা করবে। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ, অনেক নির্মাতাই ঠিকমতো যোগাযোগ রক্ষা করেন না; মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া চিঠির জবাব দেন না। কিছু ক্ষেত্রে সন্তোষজনক জবাব দেন না নির্মাতারা। ফলে বাধ্য হয়ে মামলা করতে হয় মন্ত্রণালয়কে।
মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত অনুদানের ব্যাপারে ছয়টি মামলা করেছে মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কেবল টোকন ঠাকুরের মামলাটি গ্রেফতার পর্যন্ত গড়িয়েছে।
অন্য যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারা হলেন, টোকন ঠাকুরের সঙ্গে একই বছর (২০১২-১৩) অনুদান পাওয়া যৈবতী কন্যার মন । চলচ্চিত্রটির পরিচালক নারগিস আক্তার। ২০১১-১২ সালে অনুদান পাওয়া সালাউদ্দিন জাকির পরিচালনায় একা একা । একই বছরের মারুফ হাসান আরমানের নেকড়ে অরণ্য । ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া জুনায়েদ হালিমের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের কাল ও মুরাদ পারভেজ পরিচালিত বৃহনল্লা।
এর মধ্যে নারগিস আক্তারের মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। বৃহনল্লা ২০১৪ সালে মুক্তি পেয়ে গেছে। তাও কেন এই চলচ্চিত্রের মামলাটি চলছে, সেই ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কিছু জানাতে পারেনি। বাকি চার জনের মামলা চলছে।
জুনায়েদ হালিম অনুদান নিয়েছেন ২০০৮-০৯ অর্থবছরে। ১২ বছরেও তিনি সিনেমা শেষ করেননি।
এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে জানান, মন্ত্রণালয় থেকে তিনি প্রথম কিস্তির ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। প্রি-প্রোডাকশনে দুইটি গান রেকর্ড ও লোকেশন যাচাইয়ের কাজে প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছেন। এরপর তিনি অর্থাভাবে সিনেমাটি বানানোর সিদ্ধান্ত ত্যাগ করেন। মন্ত্রণালয় টাকা ফেরত চাইলে তিনি ২০১৫ সাল থেকে তা ফেরত দেয়ার কথা বলছেন মন্ত্রণালয়কে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (চলচ্চিত্র) সাইফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে এই বিষয়ে নীতিমালার বরাত দিয়ে বলেন, ‘সরকারি টাকা নিয়ে কেউ যদি সিনেমা না বানান, তাহলে এত বছরে রেখে দেয়া টাকা ফেরত দেয়ার সময় সুদসহ ফেরত দিতে হবে।’
কিন্তু জুনায়েদ হালিম সুদসহ টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি তো আমার প্রি-প্রোডাকশনে খরচ হওয়া টাকাও দাবি করছি না। শুধু আমার সুদ যাতে বাদ দেয়া হয়, সেইটার দাবি করছি।
‘আমি বাংলাদেশের সিনেমার জন্য এত বছর কাজ করে গেলাম, আমার জন্য মন্ত্রণালয় এইটুকু করতে পারে বলে আমি মনে করি। বর্তমানে আমি দেশের চলচ্চিত্র উন্নয়নের সাথে সরাসরি যুক্ত। এমনকি ২০১৯-২০ সালে হওয়া অনুদান কমিটির একজন সদস্য আমি।’
টোকন ঠাকুরের সঙ্গে একই বছরে ছয়টি সিনেমা অনুদান পেয়েছে, যার মধ্যে টোকন ঠাকুর ও নারগিস আক্তার চলচ্চিত্র জমা দেননি এখনও।
নারগিস আক্তার নিউজবাংলাকে জানান, যৈবতী কন্যার মন চলচ্চিত্রের সব কাজ তিনি শেষ করেছেন। গত এপ্রিল মাসে মুক্তি দেয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে সেটি করা যায়নি। ডিসেম্বরে মুক্তি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলাটি এখনও জারি আছে।
তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, গত বছরের জুলাই মাসের পর থেকে তিন দফায় সব খেলাপি পরিচালককে আবারও চিঠি পাঠানো হয়েছে, যাদের সংখ্যা অন্তত ৩০। ২০১৬-১৭ সালে অনুদান পাওয়া সোহানুর রহমান সোহানকে সর্বশেষ ২ নভেম্বর চিঠি পাঠানো হয়। বলা হয়েছে, তিনি ১০ দিনের মধ্যে জবাব না দিলে তাহলে তার বিরুদ্ধেও মামলা হতে পারে।
সোহানুর রহমান সোহান নিউজবাংলাকে জানান, তিনি অনুদান নেয়ার পর দুবার ব্রেইন স্ট্রোক করায় সিনেমার কাজ শেষ করতে পারেননি। তার সিনেমার সব গান রেকর্ডের কাজ হয়ে গেছে। কিন্তু করোনার কারণে শুটিংয়ের কাজ শুরু করতে পারছেন না। তিনি জানান, প্রতিনিয়ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন তিনি।
নীতিমালার দেয়া শর্ত অনুযায়ী, চুক্তি হওয়ার ৯ মাসের মধ্যে চলচ্চিত্র শেষ করতে হয়। এ পর্যন্ত যারা মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে যথাযথভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে জমা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে অনুদান পাওয়া সুতপার ঠিকানা চলচ্চিত্রটি ২০১৫ সালে মুক্তি পায়।
চলচ্চিত্রটির পরিচালক প্রসূন রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চলচ্চিত্র নির্মাণে যারা যথাযথ পদ্ধতিগত শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসেন তারা যথাসময়েই কাজটি শেষ করবার চেষ্টা করেন। সমস্যা হয় যারা অন্য ডিসিপ্লিন থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আসেন তাদের। এ মুহূর্তে অনুদানের অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। তারপরও যাদের কাজ শেষ হচ্ছেনা তাদের চলচ্চিত্র নির্মাণে যথাযথ দক্ষতা, পরিকল্পনার দুর্বলতা ও প্যাশনের ঘাটতি থাকার কারণেও হতে পারে বলে মনে হয়।’