জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনায় বর্তমানে উত্তাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে দেয়া এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসে আম্মান সিদ্দিকী নামে তার এক সহপাঠীকে দায়ী করেন তিনি। আর আমানের সহযোগী হিসেবে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে অভিযুক্ত করে গিয়েছেন।
ঘটনার একদিন পর এ বিষয়ে কথা বলেছেন সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। অবন্তিকার অকাল মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে দেয়া এক বিবৃতিতে তার ওপর আনিত অভিযোগ অস্বীকার করেন এ শিক্ষক। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গণমাধ্যমকে কাঠগড়ায় তুলেছেন তিনি।
বিবৃতিতে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের বক্তব্য
প্রায় দেড় বছর আগে ২০২২ সালে ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে হয়রানির অভিযোগে অবন্তিকার ব্যাচমেটরা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতনামীয় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। পুলিশ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আইডিটা কে চালান তা বের করবে- এমনটা জানালে অবন্তিকা থানা থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসে আসার পথেই তার বন্ধুদের কাছে স্বীকার করে যে, ফেইক আইডিগুলো সে নিজেই চালায়। তখন তার বন্ধুরা তাকে প্রক্টর অফিসে নিয়ে এসে তার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট একটা লিখিত অভিযোগ দেয়।
প্রক্টর অফিসে অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১১ আগস্ট আমি এবং গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর গৌতম কুমার সাহা তদন্তের দায়িত্ব পাই।
পরে ১৬ আগস্ট প্রক্টর স্যারের উপস্থিতিতে আমরা অবন্তিকা ও তার অভিভাবকদের প্রক্টর অফিসে আসার জন্য আহ্বান জানালে অবন্তিকার মা মিটিং এ আসেন। সেখানে অভিযোগকারী অবন্তিকার সহপাঠীরা সবাই উপস্থিত ছিল।
তখন অবন্তিকার মা অভিযোগকারীদের কাছে ঘটনার সত্যতা শুনে তার মেয়ের ভুল স্বীকার করেছে জানিয়ে সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। ভবিষ্যতে তার মেয়ে আর এ ধরনের কাজ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। একইসঙ্গে বলেন, যদি ফের করে থাকে, তার দায় তারা নেবেন।
বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ জানালে এবং তার মেয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং ওষুধ খাচ্ছে- এমনটা জানালে অবন্তিকার ব্যাচমেটরা বিষয়টি মানবিক ও ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন। এভাবে বিষয়টা প্রাথমিকভাবে মীমাংসা করা হয়।
মীমাংসার পরে অবন্তিকার মা জিডিটা তুলে নেয়ার জন্য অভিযোগকারীদের বারবার অনুরোধ করেন, কিন্তু অভিযোগকারীরা তা তুলে নিতে অসম্মতি জানায়। কারণ তাদের ধারণা ছিল, অবন্তিকা ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ আবারও করতে পারে।
তারা তাকে পরবর্তী ৩ মাস পর্যবেক্ষণ করতে চায়। যদি সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, তাহলে তারা উল্লিখিত সময় পরে জিডিটা তুলে নেবে বলে জানায়। প্রাথমিকভাবে বিষয়টা সেখানেই সমাপ্ত হয়েছিল।
এর কিছুদিন পরে অবন্তিকা ও তার মা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং আমাকে প্রক্টর অফিসে না পেয়ে আমার বিভাগে আসেন। ওইদিন অবন্তিকার মা আমাকে জানান, অবন্তিকার হলের বন্ধুরা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে না। এতে অবন্তিকা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে।
তখন আমি তাদের প্রক্টর অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগ করার পরামর্শ দিই। অবন্তিকার মা বলেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছি না। আমি আমার মেয়েকে হলে রাখব না। কারণ এতে করে তার পড়াশোনা খারাপ হয়ে যাবে এবং সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বে।’
তখন আমি তাকে বলি, ‘আপনি অভিভাবক; যা ভালো মনে করেন, সেটাই করেন। যেকোনো প্রয়োজনে আমার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’
অভিযোগ নিষ্পত্তির ৩ মাসেরও কিছুদিন পরে অবন্তিকা এবং তার বাবা-মা প্রক্টর অফিসে জিডি তোলার জন্য আসেন, কিন্তু তার ব্যাচমেটরা জিডি তুলতে অসম্মতি জানায়। তখন তারা আবার আমাকে ফোন করে আমার বিভাগে দেখা করতে আসেন।
আমি তখন ক্লাস নিচ্ছিলাম। পরে ক্লাস থেকে বের হয়ে তাদের আমার রুমে নিয়ে যাই। সে সময় তারা জিডি তোলার বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করেন। আমি তাদের বিষয়টা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি যে, বিষয়টা আমার হাতে নেই। আমাদের কাজ তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদান করা এবং আমরা তাই করি। জিডির বিষয়ে তাদের প্রক্টর স্যার এবং অভিযোগকারীদের সঙ্গে আলাপ করে নিষ্পত্তি করার পরামর্শ দিই।
তৎক্ষণাৎ অবন্তিকার মা কিছুটা হতাশার ভাষায় বলেন, ‘আমি দুজন (অবন্তিকা এবং ওর বাবা) ডিপ্রেশনের রোগীকে নিয়ে এত বছর সংসার করে আসছি। আমি নিজেও অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমার মেয়েটা মারাত্মক ডিপ্রেশনে পড়ে গেছে।’
এরপর থেকে অবন্তিকা ও তার পরিবারের কারও সঙ্গে এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি।
অবন্তিকার ফেসবুক স্ট্যাটাস সম্বন্ধে দ্বীন ইসলামের বক্তব্য
আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ, আম্মানকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা- এসব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ ঘটনার নিষ্পত্তি তখনই হয়। এরপর এ বিষয় নিয়ে আমার কখনোই আর কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
সুইসাইড নোটে আনিত অভিযোগ ‘অবন্তিকাকে বহিষ্কার করার বিষয়ে’ পরে আমি কখনো কিছুই বলিনি। কারণ বিষয়টি মীমাংসা হওয়ার পর অবন্তিকা বা তার পরিবারের সঙ্গে বিগত দেড় বছরে একবারের জন্যও আমার কোনো কথা বা যোগাযোগ হয়নি।
প্রক্টর অফিসে অবন্তিকা এবং তার মাকে একবারই ডাকা হয়েছিল। সেই সময় প্রক্টর মোস্তফা কামাল স্যার, সহকারী প্রক্টর গৌতম কুমার সাহা স্যার এবং অভিযোগকারী তার বন্ধুরা উপস্তিত ছিলেন।
একাধিকবার ডেকে হেনস্তা করার বিষয়টিও সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। কারণ বিষয়টি ওইদিনই মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল।
সুইসাইড নোটে প্রক্টর অফিসে আম্মানের বিরুদ্ধে আনীত যৌন হয়রানি ও ভয়ভীতির অভিযোগের বিচার না পাওয়ার বিষয়টি তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল স্যার ভালো বলতে পারবেন। এ অভিযোগ সম্পর্কে আমি অবগত নই।
শেষে এ শিক্ষকের অনুরোধ
একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা এবং তাদের জন্য কাজ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। দীর্ঘ ১১ বছরের শিক্ষকতার জীবনে আমি আমার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম, ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকব।
শুধুমাত্র স্ট্যাটাসের ওপর ভিত্তি করে কাউকে ভুল না ভাবার অনুরোধ রইল।
এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য আমি সবিনয়ে প্রস্তুত।
সঠিক তথ্য জেনে সিদ্ধান্ত এবং মন্তব্য করার অনুরোধ রইল।